অটোয়া, ৩১ জুলাই – ২০২৫ সালের জুলাইয়ের শেষ দিনগুলোতে কানাডার রাজধানী অটোয়া যেন ইতিহাসের এক অমোচনীয় মুহূর্তের সাক্ষী হয়ে উঠল। আজ বুধবার ৩০ জুলাই, সংসদ ভবনের সম্মেলনকক্ষে সাংবাদিকদের সামনে দাঁড়িয়ে কানাডার প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নি ঘোষণা দিলেন— “সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে কানাডা ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেবে।”
এই ঐতিহাসিক ঘোষণার সাথে সাথেই আলোড়ন সৃষ্টি হয় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। দশকের পর দশক ধরে যে বিষয়টি পশ্চিমা রাজনীতিতে বিতর্কিত, আজ তা কানাডার একক সাহসিকতায় নতুন মোড় নিচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী কার্নি তার বক্তব্যে বলেন, “গাজায় মানবিক বিপর্যয়ের মাত্রা এখন অসহনীয়। লাখ লাখ মানুষ অনাহারে, গৃহহীন, আর ভবিষ্যতের নিরিখে সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। এই পরিস্থিতিতে নীরব থাকা যায় না। দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র ছাড়া কোনো টেকসই শান্তি সম্ভব নয়।” দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে কানাডা মুখে দুই রাষ্ট্র সমাধানের পক্ষে কথা বললেও, বাস্তবে কখনোই আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির পথে এগোয়নি। এবার সেই অবস্থানে পরিবর্তন এসেছে।
তবে এই স্বীকৃতি শর্তসাপেক্ষ। ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষকে ২০২৬ সালে নির্বাচন আয়োজন, হামাসকে প্রশাসন থেকে বাদ দেওয়া এবং রাষ্ট্রীয় নিরস্ত্রীকরণ—এই তিনটি মূল শর্ত পূরণ করতে হবে।
এই ঘোষণা কেবল একটি দেশের অবস্থান পরিবর্তন নয়, বরং এটি একটি দীর্ঘকালীন আন্তর্জাতিক দ্বিধা ভাঙার প্রথম ধাপ। ফ্রান্স এবং যুক্তরাজ্য ইতোমধ্যে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। আইরিশ, স্প্যানিশ, নরওয়েজিয়ান এবং মাল্টার মতো দেশগুলো এই স্বীকৃতির পথ আগেই দেখিয়েছে। এখন কানাডা যুক্ত হলো সেই ঐতিহাসিক কাতারে।
প্যালেস্টাইন। একটি নাম, একটি ভূখণ্ড, একটি সংগ্রাম। এর অবস্থান মধ্যপ্রাচ্যের হৃদয়ে: পশ্চিমে ভূমধ্যসাগর, পূর্বে জর্দান, উত্তরে লেবানন এবং দক্ষিণে মিশর। দুটি প্রধান ভূখণ্ড—গাজা উপত্যকা ও পশ্চিম তীর নিয়ে গঠিত বর্তমান প্যালেস্টাইন ভূগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন, আর রাজনৈতিকভাবে ভঙ্গুর।
১৯৪৭ সালে জাতিসংঘ প্যালেস্টাইন বিভাজন পরিকল্পনা অনুমোদন করে, যার ভিত্তিতে ইহুদি ও আরব রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব আসে। কিন্তু ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হতেই শুরু হয় প্যালেস্টিনীয়দের মহাবিপর্যয়। ৭ লক্ষাধিক মানুষ গৃহহীন হন, যাদের উত্তরসূরিরা আজো বিভিন্ন দেশে উদ্বাস্তু হিসেবে বেঁচে আছেন।
১৯৬৭ সালে ছয় দিনের যুদ্ধে ইসরায়েল দখল করে নেয় পশ্চিম তীর, পূর্ব জেরুজালেম ও গাজা উপত্যকা। এরপর থেকেই ফিলিস্তিন জাতির রাষ্ট্রগঠনের পথ হয়ে ওঠে রক্তাক্ত ও অনিশ্চিত। যুদ্ধের পর, পূর্ব জেরুজালেমসহ পশ্চিম তীর ও গাজা উপত্যকা ইসরায়েলের দখলে চলে গেলে ফিলিস্তিনের মানচিত্র সংকুচিত হয়ে পড়ে।
ফিলিস্তিনিরা আরব জাতিগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হলেও তাদের একটি স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক পরিচয় রয়েছে। এদের ভাষা আরবি, ধর্মবিশ্বাসে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম (সুন্নি), তবে খ্রিস্টান এবং সামান্য ইহুদি সম্প্রদায়ও রয়েছে।
প্যালেস্টিনীয় সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে লোকগাথা, কবিতা, সঙ্গীত, নৃত্য ও চিত্রকলাকে কেন্দ্র করে। মাহমুদ দারবিশ, ফাদওয়া তুকান, সামিহ আল কাসিমের কবিতা আজো আত্মপরিচয়ের ভাষ্য হয়ে উঠে আসে।
ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, এই যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত গাজায় প্রাণ হারিয়েছেন ৬০,০০০’র বেশি মানুষ—যাদের এক-তৃতীয়াংশ শিশু। জাতিসংঘের মতে, দুই মিলিয়নেরও বেশি মানুষ আশ্রয়হীন, এবং প্রায় দশ লাখ মানুষ রয়েছে দুর্ভিক্ষের মুখে।
মানবাধিকার সংস্থাগুলো জানিয়েছে, হাজার হাজার মানুষ কেবল খাদ্য ও ত্রাণ সংগ্রহ করতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছে। গাজার হাসপাতালগুলো আজ শবাগার; স্কুলে চলছে লাশ দাফন; আর রাতজাগা শিশুর কান্না আকাশকেও ভারী করে তোলে।
কানাডার এই স্বীকৃতি একটি বড় রাজনৈতিক সংকেত, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘস্থায়ী নীরবতার প্রেক্ষাপটে। ফ্রান্স ইতোমধ্যে ঘোষণা করেছে, সেপ্টেম্বরে তারা ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেবে। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ বলেন, ‘ফিলিস্তিনিদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়ার সময় এসেছে। ইসরায়েল যদি গাজায় যুদ্ধ বন্ধ না করে, তবে আমাদের আর অপেক্ষা করার সময় নেই।’
যুক্তরাজ্য বলেছে, যদি ইসরায়েল যুদ্ধবিরতিতে না যায় ও দুই-রাষ্ট্র সমাধানে না আসে, তবে তারাও ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেবে।
সাম্প্রতিক একটি জাতিসংঘ সম্মেলনে ১৫টি দেশ সম্মিলিতভাবে আহ্বান জানিয়েছে বিশ্বকে, যেন সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের আগেই ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
তবে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল এই উদ্যোগের বিরোধিতা করেছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও বলেন, “এই স্বীকৃতি হামাসের প্রচারণাকে শক্তি জোগাবে এবং শান্তি প্রক্রিয়াকে পেছনে ফেলবে।”
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইউরোপীয় দেশগুলোর ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার উদ্যোগ—বিশেষ করে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর ঘোষণাকে “তুচ্ছ” বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘Macron’s statement doesn’t carry weight,’
অটোয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক থমাস জুনো বলেন, “এই স্বীকৃতি ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষকে হামাসের বিপরীতে আন্তর্জাতিক বৈধতা দেবে। এটি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ গণতান্ত্রিক কাঠামোর মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখা সম্ভব।”
প্যালেস্টাইন শুধুমাত্র একটি ভৌগোলিক দাবির নাম নয়, এটি এক আত্মপরিচয়ের আর্তনাদ। এই ভূমি প্রার্থনার, প্রতিরোধের ও পরাধীনতার নিদর্শন বহন করে চলেছে শতাব্দীর পর শতাব্দী।
কানাডা সেই প্রথম সাহসী পশ্চিমা দেশগুলোর একটি, যারা এই জাতির দীর্ঘ প্রতীক্ষাকে একটি নৈতিক ও কূটনৈতিক স্বীকৃতি দিতে এগিয়ে এসেছে।
এই স্বীকৃতি হয়তো রাতারাতি সীমান্ত গঠন করবে না, কূটনৈতিক সঙ্কটও নিরসন করবে না। কিন্তু এটি একটি ভাষ্য—যা বলছে: “একটি জাতি যদি সংস্কৃতিতে, সাহসে, আত্মত্যাগে এবং স্বপ্নে বেঁচে থাকতে পারে—তাহলে রাষ্ট্র তার প্রাপ্য।”
উল্লেখ্য, জাতিসংঘে বর্তমানে ১৩৯টি দেশ ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে (২০২৫ পর্যন্ত)। এছাড়া ২০১২ সালে UN Observer State হিসেবে ফিলিস্তিন স্বীকৃতি পেয়েছে।