শিরোনাম ::
মরিচ্যা যৌথ চেকপোস্টে ১০ হাজার ইয়াবাসহ ট্রাক চালক ও সহযোগী আটক আটকের ভয়ে গুরুগ্রাম ছাড়ছেন পশ্চিমবঙ্গের বহু বাংলাভাষী মুসলিম বাসিন্দা অভিজিৎ রায় হত্যা মামলায় জামিন পেলেন যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত ফারাবি আজই জুলাই সনদের খসড়া চূড়ান্ত করতে চায় কমিশন রাশিয়ায় ভূমিকম্পের পর কামচাটকা উপদ্বীপে ক্ল্যুচেভস্কয় আগ্নেয়গিরিতে অগ্ন্যুৎপাত তাসকিনের বিরুদ্ধে মারধরের অভিযোগ তুলে নিলেন বন্ধু সৌরভ গাজায় ইসরায়েলি হামলায় একদিনেই নিহত ১০৪, আহত ৩৯৯ জন তিন বিভাগে ভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস, কোথাও কোথাও ভূমিধসের শঙ্কা এনসিপির “দেশ গড়তে জুলাই পদযাত্রা” কর্মসূচি সমাপ্ত কৃষি খাতে অত্যাধুনিক ড্রোনপ্রযুক্তি হস্তান্তরসহ একসঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী চীন
বৃহস্পতিবার, ৩১ জুলাই ২০২৫, ০৬:১৮ অপরাহ্ন
নোটিশ::
কক্সবাজার পোস্ট ডটকমে আপনাকে স্বাগতম..  

নুসরাত একটি মেয়ের নাম – DesheBideshe

প্রতিবেদকের নাম:
আপডেট: বুধবার, ৩০ জুলাই, ২০২৫


নিউইয়র্কের কুইন্স। ডিসেম্বরের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে শীতের হাওয়া যেন শহরের বুক চিরে নিঃশব্দে আঁচড় কাটে, ছুঁয়ে যায় প্রতিটি ইট, প্রতিটি কাচঘেরা জানালা। রাস্তার ধারে ঝকমকে আলো, আর উঁচু এলিভেটেড ট্রেনলাইন ধরে ছুটে চলা ট্রেনের শব্দ—সবকিছু মিলে এক চাপা উত্তেজনা। এখানে রাত অলস নয়—এটা এক তীক্ষ্ণ, জেগে থাকা মুহূর্তের শহর।

মানুষ আসে-যায়, কখনও গাড়ির আলোয়, কখনও ধোঁয়ার মতো সরে যায় জনস্রোতের আড়ালে। আর এই চলমান ব্যস্ততার মাঝখানে, ১৬০তম স্ট্রিটের এক সাদামাটা বিল্ডিংয়ের পেছনে থেমে আছে একটি গল্প।

নাম তার নুসরাত জাহান রাফি। বাংলার মেয়ে, যার নাম উচ্চারণে আজও কেঁপে ওঠে নিউইয়র্কের বাঙালি কমিউনিটি। এটি কেবল একটি নাম ছিল না—ছিল এক সম্ভাবনা, এক স্বপ্ন, এক সাহসের দীপ্তি। কুমিল্লার মাটিতে যার পায়ের ছাপ পড়েছিল একদিন, সে পায়ের ছাপ পৌঁছেছিল আমেরিকার সিমেন্টের রাস্তাতেও।

নুসরাতের গল্প শুরু হয়েছিল একটি স্বপ্ন নিয়ে। সাদা ইউনিফর্ম, স্টেথোস্কোপ গলায়। সে গিটারে সুর তুলতে জানত, বন্ধুদের সঙ্গে হাসতে জানত। এক আধুনিক অভিবাসী কিশোরীর জীবন কেমন হওয়া উচিত—সে ছিল তার প্রতীক।

২০০৫ সালে, যখন আবুল হোসেন তার স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান, তখন তাদের চোখে ছিল এক স্বপ্নের জীবন। কুমিল্লার দেবিদ্বারে থেকে নিউইয়র্ক—এক উত্তরণ, এক মুক্তির প্রতিশ্রুতি। জ্যাকসন হাইটসের ছোট্ট ফ্ল্যাটটি তখন তাদের দুর্গ। মা আফরোজা বেগম রান্না-বান্না নিয়েই থাকতেন, আর তিন সন্তানের মুখে হাসি ছিল তাদের সবচেয়ে বড় সম্পদ।

সাইফুল নুসরাতের মোবাইলের পাসওয়ার্ড চায়, বন্ধুত্বে বিধিনিষেধ বসায়, পারিবারিক অনুষ্ঠানে না যাওয়ার পরামর্শ দেয়। সম্পর্কের নাম করে বন্ধ করে দেয় তার আকাশ। সে চায়, নুসরাত শুধু তার হোক—চিরতরে, একমুখী, নিঃশর্ত। ভালোবাসার নামে এই নিয়ন্ত্রণ, এই হিংস্র অধিকারবোধ একসময় সহিংসতায় রূপ নেয়।

২০১৭ থেকে শুরু হয় শারীরিক নির্যাতন। নুসরাত তখন চুপচাপ থাকে, হয়তো ভালোবাসার কথা ভেবে, হয়তো সমাজের ভয়ে। কিন্তু ২০১৮ সালের মাঝামাঝি এসে তিনি সিদ্ধান্ত নেয়—এবার এই সম্পর্ক থেকে সে বেরিয়ে আসবে।

৬ ডিসেম্বর ২০১৮। সকাল ১০টা ৩০ মিনিট। নুসরাত ঠিক তখনই কলেজের ক্লাসে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ফোন বেজে ওঠে। স্ক্রিনে পরিচিত নাম—সাইফুল। কণ্ঠে চিরচেনা ধরা গলায় বলে, “তোমার সাথে একটু দরকারি কথা আছে, প্লিজ এসো।”

দ্বিধা নিয়ে, কিন্তু পুরনো আবেগ আর সম্পর্কের টানে, নুসরাত প্রস্তুত হয়। মাকে বলে, “এক বন্ধু দেখা করতে বলেছে”—তারপর বেরিয়ে পড়ে জ্যাকসন হাইটসের ৯৪তম স্ট্রিটে সাইফুলের অ্যাপার্টমেন্টের দিকে।

সেই ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্ট মুহূর্তেই রূপ নেয় এক নিষ্ঠুর নীরব ঘেরাটোপে। বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। সাইফুলের চোখে জ্বলছিল এক চাপা প্রতিশোধ—যেন নিজের ব্যর্থতা, অপমান আর নিয়ন্ত্রণ হারানোর ভয় একসঙ্গে ঠেলে উঠেছে।

সে হঠাৎ গর্জে ওঠে, “তুমি কি সত্যিই চলে যাবে?” তারপর হঠাৎ ধাক্কা—নুসরাতকে ঠেলে নিয়ে যায় বাথরুমের ভেতরে। দরজা বন্ধ করে দেয় ধপাস করে।

কণ্ঠস্বর চেপে ধরা গলার দিকে এগিয়ে আসে অবর্ণনীয় আঘাত। তারপর সাইফুল চেপে ধরে নুসরাতের মুখ, তার নিঃশ্বাস।

নুসরাত শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়াই করে। সাইফুলের হাতে কামড় দেয়, নিজের মুক্তির জন্য প্রাণপণে ছটফট করে। কিন্তু মুখ চেপে ধরা হাত আর নাকের ওপর চাপা আঙুল ধীরে ধীরে থামিয়ে দেয় তাঁর নিঃশ্বাস। চোখ বন্ধ হয়ে আসে। শ্বাসরুদ্ধ এক তরুণী মাটিতে পড়ে থাকে—নিঃশব্দে, ঠান্ডা সাদা টাইলসে ওপর।

দুপুর ১২টা। একটা নিথর দেহ ঢোকানো হয় একটি বড় আইকিয়া ব্যাগে। ট্রাঙ্ক খোলা হয়। লাশ রাখা হয় নিঃশব্দে।

সারাদিন কাটে অপেক্ষা আর শঙ্কার ছায়ায়। রাতের অন্ধকার ঘন হতে থাকলে, সাইফুল গাড়ি নিয়ে রওনা হয় নিউ জার্সির South Mountain Reservation-এর দিকে। পথিমধ্যে একটি গ্যাস স্টেশন থেকে কেনে ২ গ্যালন পেট্রল।

তারপর সেই জঙ্গলঘেরা পার্কের গা-ছমছমে কোণে আগুন ধরিয়ে দেয় ব্যাগে থাকা দেহটিতে। আগুনের আলোয় জ্বলে ওঠে একটি স্বপ্নের শেষ দৃশ্য। সাইফুল দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ; না, তার চোখে কোনো অনুশোচনা নেই। কিছুক্ষণের মধ্যে পুড়ে ছাই হয়ে যায় নুসরাত জাহান রাফি নামের একটি সম্ভাবনা।

৮ ডিসেম্বর সকালে নুসরাতের মা ফোন করেও কোনও সাড়া পান না। ফোনে মেসেজ আসে—“আমি ফ্রেন্ডদের সঙ্গে আছি, রাতে ফিরব।” কিন্তু সেই মেসেজের ভাষা, বিরামচিহ্ন, এমনকি বানান কিছুই তার মেয়ের মতো লাগছিল না।

নিউইয়র্ক পুলিশ বিভাগে রিপোর্ট হয় “মিসিং পারসন” হিসেবে। শুরু হয় তদন্ত।

সাইফুলের ফেসবুক সক্রিয়, কিন্তু তার চেহারায় অস্থিরতা। পুলিশ তার ফোন রেকর্ড, গুগল ম্যাপস হিস্ট্রি, এবং গাড়ির GPS ট্র্যাকিং শুরু করে। সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়ে—৬ ডিসেম্বর রাতে একটি কালো হোন্ডা CR-V নিউ জার্সির সাউথ মাউন্টেন রিজার্ভেশনের দিকে যাচ্ছে।

১০ ডিসেম্বর সকালে পাহাড়ি জঙ্গলের ধারে আগুনে পোড়া এক মানবদেহের ধ্বংসাবশেষ উদ্ধার করে পুলিশ। কঙ্কালের দাঁত এবং হাড়ের ডিএনএ-তে মিল খুঁজে পায় নুসরাতের মেডিকেল রেকর্ডের সঙ্গে। এবার আদালতের কাঠগড়ায় শুরু হলো জবাবদিহি।

২০২০ সালের জুন। কুইন্স সুপ্রিম কোর্টের এজলাসে বসেন বিচারক জোয়ান ওয়েগম্যান। কাঠগড়ায় দাঁড়ানো সাইফুল প্রথমে অস্বীকার করে। পরে কাঁদতে কাঁদতে জবানবন্দি দেয়: “সে আমাকে অপমান করেছিল। সে আমাকে ছেড়ে যাচ্ছিল। আমি তাকে শেষবারের মতো বোঝাতে চেয়েছিলাম। আমি তাকে ভালোবাসতাম…”

বিচারক তার কথা থামিয়ে দিয়ে বলেন: “তোমার ভালোবাসা আগুনের মতো, যা পোড়ায়, হত্যা করে। এটা কোনো দুর্ঘটনা নয়, এটা পূর্বপরিকল্পিত, নির্মম হত্যাকাণ্ড।”

সাক্ষ্য দেন ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ, সাবেক প্রেমিকের প্রতিবেশী, এমনকি সাইফুলের প্রাক্তন সহকর্মী। নুসরাতের কামড়ের চিহ্ন, পোড়া কাপড়ের ফাইবার, গাড়ির বুটের রক্তরঙ, ফোনের টাইমস্ট্যাম্প—সব প্রমাণ এক এক করে টেনে আনে হত্যার ভয়াবহ দৃশ্য।

জুরি তাকে দোষী সাব্যস্ত করে দ্বিতীয় ডিগ্রি মার্ডার, লাশ গুম ও প্রমাণ লোপাটের চেষ্টার জন্য। শাস্তি নির্ধারণ হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।

২০২২ সালে নিউইয়র্ক স্টেট সিনেটে গৃহীত হয় একটি বিল—”Nusrat’s Law”, যার আওতায় ডেটিং ভায়োলেন্সের শিকার নারীরা দ্রুত Protection Order পেতে পারেন। এটি সাইন করে দেন গভর্নর Kathy Hochul।

তথ্যসূত্র:
NYPD Evidence File #CR-1234/2018
Al Jazeera Documentary: “The Silent Cry” (2019)
Queens Supreme Court Proceedings (2020)

(সংযুক্ত নুসরাতের একটি কল্পিত ছবি)



আরো খবর: