ভালোবাসা কি কেবল মানুষের জন্যই সংরক্ষিত? না, ভালোবাসা অনুভূতির একটি বিশুদ্ধ প্রকাশ—যা গাছ, পশু, পাখি, এমনকি প্রকৃতির প্রতিটি কণার প্রতিও ছড়িয়ে পড়তে পারে। মানুষ যখন নিঃসঙ্গ হয়, তখন সেই শূন্যতা পূরণে পাশে এসে দাঁড়ায় এক নিঃস্বার্থ সঙ্গী—একটি পোষা প্রাণী। যাদের নেই কোনো চাহিদা, নেই কোনো ছলনা, নেই কোনো অহং—আছে শুধু নিখাদ প্রভুভক্তি। পশ্চিমা বিশ্বের অলিগলিতে পোষা প্রাণীর চোখে চোখ রাখলেই তা বোঝা যায়।
ইউরোপ-আমেরিকার সৌখিন নাগরিকরা ঘরে পোষা প্রাণী রাখেন—এটা তাদের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। এখানকার সমাজে এটি একেবারেই সাধারণ ও সর্বজনগ্রাহ্য বিষয়। কেউ প্রাণীর প্রতি মমতা থেকে রাখেন, কেউ রাখেন প্রয়োজনের তাগিদে। যেমন—অন্ধ মানুষদের পথপ্রদর্শক হিসেবে প্রশিক্ষিত কুকুরকে রাখা হয়, যারা এতটাই দক্ষ যে বাসের নম্বর, হাসপাতাল কিংবা সুপার মার্কেটের নাম পর্যন্ত চিনে নিতে পারে। আশ্চর্যের বিষয়, এই কুকুরগুলো শুধু পথ দেখায় না, প্রয়োজনে তাদের মালিককে মৃত্যুর মুখ থেকেও ফিরিয়ে আনতে পারে।
পুলিশ বিভাগে ব্যবহৃত কুকুরগুলো আরও প্রশিক্ষিত ও অগ্রসর। ড্রাগস, অস্ত্র, এমনকি অপরাধী শনাক্ত করতে এদের ক্ষমতা অসামান্য। মাটির নিচে পুঁতে রাখা মাদকদ্রব্য তারা ঘ্রাণে চিহ্নিত করতে পারে। সেনাবাহিনীতেও আছে এমন কিছু কুকুর যারা অফিসার রেংক (Rank)-এর মর্যাদা পেয়ে থাকে। সত্যিই, বিস্ময়কর তাদের প্রতিভা!
অনেক বৃদ্ধ, একাকী কিংবা নিঃসন্তান মানুষ কুকুর বা বিড়ালকে নিজের সন্তানতুল্য ভালোবাসেন। তারা এদের শুধু পোষেনই না, তাদের সঙ্গে কথা বলেন, হেঁটে বেড়ান, এমনকি মৃত্যুর আগে তাদের জন্য সম্পত্তি লিখে রেখে যান—এমন ঘটনাও বিরল নয়।
WHO ও CDC-এর গবেষণা অনুযায়ী, পোষা প্রাণী মালিকদের মধ্যে স্ট্রেস, অবসাদ, এবং একাকীত্বের হার তুলনামূলকভাবে কম থাকে। বিশেষ করে বৃদ্ধদের ক্ষেত্রে পোষা প্রাণী মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী।
স্ট্যাটিসটিক্স কানাডা এবং কানাডিয়ান অ্যানিমেল হেলথ ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, কানাডায় পোষা প্রাণীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বর্তমানে প্রায় ১২.২ মিলিয়ন কানাডিয়ান পরিবার কুকুর বা বিড়াল পোষে, যেখানে ৫০.৯ শতাংশ পরিবার বিড়াল এবং ৪৯.১ শতাংশ পরিবার কুকুর পোষে। সর্বশেষ ২০২৪ সালের হিসাব অনুযায়ী, কানাডায় বিড়ালের সংখ্যা প্রায় ৮.৯ মিলিয়ন এবং কুকুরের সংখ্যা প্রায় ৮.৩ মিলিয়ন।
জনমত জরিপে দেখা গেছে, কুকুর মানুষের প্রিয় বন্ধু হিসেবে স্থান পেলেও জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে বেড়ালের স্থান সবসময়ই শীর্ষে। বেড়ালকে মানুষ খুব ভালোবাসে এবং আদর করে।
তবে শুধু কুকুর ও বিড়ালেই সীমাবদ্ধ নয়। একই পরিসংখ্যানে দেখা যায়, কানাডায় পোষা প্রাণী হিসেবে রয়েছে প্রায় ২.৫ মিলিয়ন পাখি, ৮.৬ মিলিয়ন অ্যাকোয়ারিয়াম মাছ, ১.২ মিলিয়ন ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণী (যেমন: খরগোশ, গিনিপিগ), এবং ২৭৪ হাজারের বেশি সরীসৃপ (যেমন: সাপ, কচ্ছপ, গিরগিটি)।
এছাড়া, পোষা প্রাণীর সেবায় কানাডায় রয়েছে ৬,৩১৯টি পশুচিকিৎসা প্রতিষ্ঠান, যেখানে রোগ নির্ণয়, অস্ত্রোপচার, টিকা প্রদান থেকে শুরু করে আধুনিক চিকিৎসার সব ব্যবস্থা রয়েছে। এদের পাশাপাশি রয়েছে প্রায় ৫,৯০০টি পোষা প্রাণী সেবা প্রতিষ্ঠান (যেমন: গ্রুমিং, ট্রেনিং, পোষ্য বাসস্থান, কুকুর হাঁটানো) এবং ৩,৫৪৯টি পোষা প্রাণী ও সামগ্রী বিক্রয়ের দোকান। এমনকি রয়েছে তারকা মানের হোটেলও!
কানাডার বিভিন্ন শহরে কুকুর-বিড়ালের সমিতিও আছে। ‘কানাডিয়ান ক্যানেল ক্লাব’ এবং ‘কানাডিয়ান ক্যাট অ্যাসোসিয়েশন’ এ দুটি সংগঠন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। দেখা গেছে কুকুরের মধ্যে ল্যাব্রাডর সবচেয়ে জনপ্রিয়, এরপরেই জার্মান শেপার্ড। বিড়ালের মধ্যে জনপ্রিয়তার শীর্ষে রয়েছে হিমালয়ান, তারপর পার্সিয়ান ও সিয়ামিজ।
আশ্চর্য লাগে, কানাডার পোষা প্রাণীর বাজার প্রতি বছর ১৮০ কোটি ডলারের বেশি মূল্যের—এ যেন শুধু প্রেম বা শখ নয়, এক বিশাল শিল্প, এক সাংস্কৃতিক বাস্তবতা।
আমেরিকান পেট ফুড ইন্ডাস্ট্রির তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৯ কোটি বিড়াল এবং ৮ কোটি কুকুর পোষা হয়! ইউরোপীয় দেশগুলোর অধিকাংশ নাগরিকের ঘরেই পোষা প্রাণী রয়েছে। জাপান, চীন, দক্ষিণ কোরিয়াতে পোষা প্রাণী ঘরে রাখা সামাজিক মর্যাদার প্রতীক। আর অস্ট্রেলিয়া, নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, লুক্সেমবার্গ ও ইতালিতে পাখি হলো সবচেয়ে জনপ্রিয় পোষা প্রাণী। কেউ কেউ আবার খরগোশ, গিনিপিগ, কচ্ছপ, এমনকি ট্যারান্টুলাও পোষেন!
কুকুর নিয়ে বহু গল্প আছে। তবে এক অবিশ্বাস্য গল্প শুনুন আমার কাছ থেকে।
ঘটনাটি নিউ ব্রান্সউইকের বাসিন্দা জেমস পল স্ট্যানসন নামের এক ব্যক্তিকে ঘিরে। তার মাথায় একদিন উদ্ভট এক চিন্তা চেপে বসে—সে চায় আজীবন জেলে থাকতে! কেননা, তার বিশ্বাস—জেলই সবচেয়ে আরাম আয়েশের জায়গা। কাজ নেই, চিন্তা নেই, ফ্রি খাওয়াদাওয়া, ঘুম, আর নিশ্চিন্ত জীবন।
কিন্তু সমস্যা হলো, একজন মানুষ খুন করলে কয়েক বছর পর জামিনে বের হয়ে যেতে হয়। তাই সে সিদ্ধান্ত নেয়—একজন নয়, যত বেশি সম্ভব মানুষ হত্যা করবে, যেন সে চিরজীবনের মতো জেলের মেহমান হয়ে যায়! ভবিষ্যৎ গণহত্যার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে সে গোলাবারুদ, শটগান, রাইফেল, এমনকি স্বয়ংক্রিয় পিস্তল জোগাড় করে সোজা চলে আসে টরন্টো শহরে।
একটি পার্কে বসে সে নিজের ভেতরের খুনি মনটাকে প্রস্তুত করছিল—এই বুঝি চেপে ধরবে ট্রিগারে আঙুল! আর ঠিক তখনই ঘটে এক অলৌকিক ঘটনা।
পার্কের পাশে হঠাৎ একটি অচেনা কুকুর এসে তার পাশে বসে খেলা শুরু করে। আদর দেয়, পা চাটে, লেজ নাড়ে। সেই কুকুরটার নিঃস্বার্থ সঙ্গ, চোখের কোমলতা আর সরল মন যেন এক লহমায় গলিয়ে দেয় ভয়ঙ্কর খুনির হৃদয়।
জেমস থমকে যায়। সে ভাবে—‘যে এলাকার কুকুর এত সুন্দর, এত নিরীহ, এত আন্তরিক, সেই এলাকার মানুষ নিশ্চয় আরও চমৎকার হবে। আমি এদের কেমন করে হত্যা করব?’
পরিকল্পনার মোড় ঘুরে যায়। সে অস্ত্র ফেলে পুলিশ স্টেশনে গিয়ে নিজেই আত্মসমর্পণ করে। সব কথা খোলাখুলি জানায়। বলে—‘আমি খুন করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু কুকুরটার সরল খেলার ভঙ্গি আমায় থামিয়ে দিল।’ এ এক অভূতপূর্ব ঘটনা। যেখানে কোনো বক্তৃতা, বন্দুক বা আইন নয়—একটি কুকুরের আচরণই বদলে দেয় এক খুনির নিয়তি!
সম্প্রতি জার্মান গবেষকরা জানিয়েছেন, কুকুর মানুষের দৃষ্টি ও অঙ্গভঙ্গি পড়ে নিতে পারে। তাদের মস্তিষ্ক এতটাই সক্রিয় যে তারা পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে সমস্যার সমাধান করতে পারে।
জীবনের পথচলায় মানুষ আজ অনেকটাই যান্ত্রিক ও আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে। অথচ পাশে তাকালেই দেখা যায়—একটি প্রাণী নিঃস্বার্থভাবে অপেক্ষা করছে একটু আদরের আশায়। পোষা প্রাণী শুধু বিনোদন নয়, তারা আমাদের জীবনের অংশ, বন্ধু, এবং অনেক সময় পরিবারের মতোই আপন হয়ে ওঠে।
ভালবাসা, মমতা ও নিঃস্বার্থতা—এই তিনটি গুণ যদি একত্রে কোথাও দেখা যায়, তবে তা মিলবে এক নিষ্পাপ পোষা প্রাণীর চোখে। আমাদের উচিত শুধু মানুষ নয়, সমস্ত জীবজগৎকে ভালোবাসা, সম্মান ও সহানুভূতির চোখে দেখা। কারণ, যে সমাজ প্রাণীর প্রতি মানবতা শেখে, সে সমাজ-ই আসলে সত্যিকারের মানবসমাজ।