August 10, 2025, 6:06 pm
নোটিশ::
আমাদের নতুন ডোমেইনে আপনাকে স্বাগতম, কক্সবাজার পোস্ট ডটকমের জনপ্রিয়তাকে পুজিঁ করে অনেক নতুন ফেইসবুক পেইজ খোলা হয়েছে,তাদের কার্যকলাপের জন্য আমরা দায়ী নয়  

ব্রাডফোর্ডের সুমাইয়া বেগমের স্বপ্ন – DesheBideshe

প্রতিবেদকের নাম:
আপডেট: রবিবার, আগস্ট ১০, ২০২৫


সুমাইয়া বেগমের কল্পিত ছবি

ব্রিটেনের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত ইয়র্কশায়ার—সবুজ উপত্যকা, পাথুরে টিলা আর শিল্পঐতিহ্যের নিঃশব্দ সাক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এক পরিচিত শহরের নাম ব্রাডফোর্ড। একসময় এই শহরের কারখানাগুলো গর্জে উঠেছিল টেক্সটাইল বিপ্লবের তালে। আজ এ শহরে বাস করে নানান ভাষাভাষী মানুষ। পাথরের বাড়ি, সরু গলি, মেঘে ঢাকা রাস্তাগুলোকে ঘিরে গড়ে উঠেছে এক মিশ্র সমাজ।

ব্রাডফোর্ডের বুকজুড়ে গড়ে উঠেছে এক শক্তিশালী বাংলাদেশি কমিউনিটি। শহরের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা এই মানুষেরা কেউ ট্যাক্সি চালান, কেউ কারখানায়, কেউ দোকানে, কেউবা অফিসে। বারকারেন্ড, থর্নবেরি, ম্যানিংহ্যাম—এসব এলাকায় বাংলায় লেখা সাইনবোর্ড; মসজিদে আর গ্রোসারি দোকানে আলাপচারিতায় বোঝা যায়—এটা যেন এক টুকরো সিলেট।

কোনো রাস্তা দিয়ে হাঁটলে হঠাৎ দেখা মিলবে স্কুল ড্রেস পরা কিশোরীদের দল, যাদের কেউ কেউ হিজাবে ঢাকা, কেউবা চুলে রং লাগানো। অভিবাসী পরিবারগুলোর ঘরে জন্ম নেওয়া প্রজন্ম আজ হাঁটে দু’টি সংস্কৃতির মাঝে—একটিতে তাদের পূর্বপুরুষদের শেকড়, আরেকটিতে তাদের নিজেদের বেছে নেওয়া পরিচয়।

ঠিক এই শহরের বুকেই একদিন নিঃশব্দে ঝরে পড়ে একটি স্বপ্ন। একটি মেয়ে, যার মুখে ছিল চিরচেনা হাসি, চোখে ছিল প্রতিজ্ঞার দীপ্তি, আর পায়ে ছিল সমাজ বদলের সাহসী পদচিহ্ন—তার নাম ছিল সুমাইয়া বেগম।

সিলেটের একটি অখ্যাত গ্রামের নাম মনে নেই আজ আর কারো, কিন্তু সেখান থেকেই শুরু হয়েছিল এ গল্প। নব্বই দশকের শুরুতে জীবিকার তাগিদে আব্দুল করিম আর তার স্ত্রী আয়েশা বেগম দেশ ছেড়ে এসেছিলেন এই দূরদেশে। প্রথমদিকে করিম কাজ করতেন একটি টেক্সটাইল ফ্যাক্টরিতে, পরে নিজের চেষ্টায় খুলে ফেলেন একটি ছোট্ট গার্মেন্টসের দোকান। আয়েশা বেগম ঘরের মধ্যে সেলাইয়ের কাজ করতেন, আর বাইরের দুনিয়ার সাথে যোগাযোগ বলতে শুধু পাশের প্রতিবেশী আর মসজিদের ইমামের পরিবার। কিন্তু ব্রাডফোর্ডের বারকারেন্ড এলাকায় তাদের সেই সাদামাটা জীবনে একটি উজ্জ্বল ফুল ফুটেছিলো, তার নাম সুমাইয়া। ২০০২ সালে জন্ম নেওয়া এই মেয়েটি দেখতে যেমন মায়াবী, তেমন তার চাহনিতেই ছিল এক অভাবিত দৃঢ়তা।

সুমাইয়া স্কুলে ছিল মেধাবী, বিনয়ী আর মন খোলা এক কিশোরী, যার স্বপ্ন ছিল একদিন সমাজের জন্য কিছু করা। সময় গড়িয়ে গেছে। সুমাইয়া বড়ো হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে উঠেছে। লিডস বেকেট বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজকর্ম নিয়ে পড়তে পড়তে সে স্থানীয় কমিউনিটি সেন্টারে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করতে শুরু করল। শিশুদের পড়ানো, বয়স্কদের ফর্ম পূরণে সাহায্য করা, মেয়েদের নিয়ে সচেতনতা কর্মশালায় অংশ নেওয়া-এসব ছিল তার নিত্যদিনের ব্যস্ততা। সবসময় সে বলতো—“আমি চাই আমাদের কমিউনিটির মেয়েরা শিক্ষিত হোক।”

ছয়দিন পর, ১ জুলাই—একটি ফোন আসে থানায়। হ্যাপি ভ্যালি পিকচার হাউস নামের একটি পরিত্যক্ত সিনেমা হলের পাশ থেকে ভেসে আসছে দুর্গন্ধ। পুলিশ গিয়ে যা দেখে, তা যেন কোনো ক্রাইম থ্রিলারের চিত্রনাট্য নয়, এক বাস্তব বিভীষিকা। একটি কার্পেটে মোড়ানো লাশ, গলা টিপে হত্যা করা হয়েছে। মেয়েটির মুখ চেনা, শরীর চেনা, শুধু প্রাণ নেই। সুমাইয়া—নিঃসন্দেহে।

এরপর তদন্তে উঠে আসে এক অভিশপ্ত নাম—হাশেম ইব্রাহিম আবেদিন। বয়স একত্রিশ। সুমাইয়ার চাচাতো ভাই। একটি কুরিয়ার কোম্পানির ড্রাইভার। জানা যায়, হাশেম সুমাইয়াকে বিয়ে করতে চেয়েছিল। পারিবারিকভাবে সে চাপ দিচ্ছিল, গোপনে হুমকিও দিত। সুমাইয়া স্পষ্টভাবে তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে তাকে, বলেছিল, “আমি পড়াশোনা শেষ করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই।” হাশেমের দৃষ্টিতে এই উত্তর ছিল এক চরম অবমাননা। সে অপবাদ দেওয়া শুরু করে—“সুমাইয়াতো পশ্চিমা সংস্কৃতিতে ডুবে গেছে।”

সেদিন সে ফোন করে ডাকে সুমাইয়াকে। হয়তো বলেছিল, “একবার আমার সাথে দেখা করো, তোমার সাথে কিছু কথা বলার আছে।” সরল বিশ্বাসে সুমাইয়া নির্দিষ্ট স্থানে চলে আসে। আর সেখানেই হাশেম তাকে গলা টিপে হত্যা করে। তারপর নিথর দেহ কার্পেটে মুড়ে ফেলে আসে সেই পরিত্যক্ত সিনেমা হলের পেছনে।

সুমাইয়ার মৃত্যুর খবরটি ছড়িয়ে পড়ে সারা ব্রিটেনে। বিশেষ করে ব্রাডফোর্ডের বাংলাদেশি কমিউনিটিতে যেন এক বেদনার বিস্ফোরণ ঘটে।



আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরো খবর: