August 17, 2025, 9:28 pm
নোটিশ::
আমাদের নতুন ডোমেইনে আপনাকে স্বাগতম, কক্সবাজার পোস্ট ডটকমের জনপ্রিয়তাকে পুজিঁ করে অনেক নতুন ফেইসবুক পেইজ খোলা হয়েছে,তাদের কার্যকলাপের জন্য আমরা দায়ী নয়  

আগুনের তাপে ইতিহাস লিখেছে বার্সেলোনার শারমিন

প্রতিবেদকের নাম:
আপডেট: রবিবার, আগস্ট ১৭, ২০২৫


শারমিন সুলতানার কল্পিত ছবি

মেডিটেরেনীয় নীলের শহর বার্সেলোনা। সমুদ্রের দিকে ঢালু পথ, পুরোনো পাথরের গলি, গথিক প্রাচীরের ছায়ায় কাতালানের প্রাণ, আর লা রাম্বলার অবিরাম পদধ্বনি। এই শহর যেন এক মোজাইক; রঙিন টাইলের ছাঁদে জুড়ে আছে পৃথিবীর বিচিত্র মুখ। কাতালান, আন্দালুস, মরোক্কান, সিরীয়, তার সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার ভাষার তরঙ্গিত ছন্দ।

এল রাভাল। সংকীর্ণ রাস্তায় দোকান, বার, ছোট রেস্তোরাঁ; দেয়ালে দেয়ালে বার্সার পতাকা। কোথাও মুখাবয়বে ভেসে ওঠে সিলেটের কুশিয়ারার তীর; কোথাও কুমিল্লার মেঘনা-বুকে ভেসে থাকা ছোট নৌকার রেখা। দিনের শেষে আলো যখন গির্জার মিনারে গা ঘেঁষে সরে যায়, শহরের কাজ তখনও থামে না।

কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দির তরুণ আহসান হক। যার লক্ষ্য ছিল ইউরোপে দাঁড়িয়ে একদিন নিজের পায়ের নিচে মাটি শক্ত করা। ২০১৫ সালে কাতালোনিয়ায় থাকা চাচা জালাল উদ্দিনের সহায়তায় তিনি বার্সেলোনায় আসেন।

২০১৭ সালে আহসান বাংলাদেশে গিয়ে বিয়ে করেন সিলেটের সুরমা পারের মেয়ে শারমিনকে। ওই বছরেরই শেষদিকে পারিবারিক পুনর্মিলনের কাগজে শারমিন বার্সেলোনায় পৌঁছান।

তাদের বাসা ছিল এল রাভালের “Spice Garden” রেষ্টুরেন্ট -এর ওপরের তলায়। রেষ্টুরেন্টের কাগজে-কলমে নামমাত্র মালিক ছিলেন আহসান। প্রকৃত মালিক ছিলেন চাচা জালাল উদ্দিন। দীর্ঘ ২০ বছর ধরে তিনি বার্সেলোনার নাগরিক।

রেষ্টুরেন্টটিতে মাসে গড়ে ৩,৫০০ ইউরো লাভ হতো। এর মধ্যে ১,২০০ ইউরো নগদ যেত আহসানের নামে বেতন হিসেবে। বাকি ২,৩০০ ইউরো জমা পড়ত জালাল উদ্দিনের অ্যাকাউন্টে।

দিনপঞ্জির পাতায় ২০২২ সালর ২৭ এপ্রিল, বিকেল। ঝগড়া শুরু হয় কোনো এক অজুহাতে। রান্নাঘরেই সবকিছু ঘটে। চুলায় এক পাত্রে তেল গরম হচ্ছিল; উত্তাপ বাড়তে থাকলে তা কেবল যেন তাপমাত্রাই বাড়ায় না, একজন মানুষের ভিতরের আঁধারকেও উস্কে দিতে পারে। মুহূর্তের মধ্যে এমন একটি ঘটনা ঘটে গেলো। গরম তেলের স্রোত বুক, পিঠ, ঘাড়ের ওপর পড়তেই শারমিন চিৎকার করে ওঠে।

দরজার ওপারে যারা বহুদিন ধরে ভাবছিলেন, “এই পরিবারের হাসিটা যেন মলিন”—সেই প্রতিবেশীরাই দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকলেন। কেউ আনলেন আগুন নিভানোর জন্য কম্বল, কেউ ফোন করলেন জরুরি পরিষেবায়। দশ মিনিটের মধ্যে অ্যাম্বুলেন্স আসে। শারমিনকে নেওয়া হলো স্থানীয় Hospital del Mar–এ। চিকিৎসকেরা বললেন, শরীরের প্রায় ৪০% অংশ তৃতীয়-ডিগ্রির দাহ; শ্বাসনালিতেও ক্ষতি। প্রথম ৪৮ ঘন্টার মধ্যে জীবন রক্ষার দৌড়। চলবে টানা অস্ত্রোপচার।

ঘটনার পর তদন্তে নামে কাতালান পুলিশ Catalan Police)। রান্নাঘর থেকে উদ্ধার হওয়া তেলের পাত্রে আহসানের আঙুলের ছাপ; চার প্রতিবেশীর সাক্ষ্য, এক প্রতিবেশীর হাতে-ধরা রেকর্ডারে ধরা পড়ে শারমিনের চিৎকার “তুমি আমাকে শেষ করে দিচ্ছ!”

এইসব প্রমাণ চলে যায় বার্সেলোনার প্রাদেশিক আদালতে। জামিন পান না অভিযুক্ত আহসান। তিনি শুরুতে অস্বীকার করেন; তারপর খন্ডিত স্বীকারোক্তি। তবে সত্যের সঙ্গে সেই স্বীকারোক্তির যৌথ স্বাক্ষর মেলে না। শারমিন ভিডিও কনফারেন্সে সাক্ষ্য দেন। স্ক্রিনের ওপারে তার কণ্ঠে ভেসে আসে একটি বাক্য: “আমি বাঁচতে চাই”। এই বাক্যটি আইনকেও নতুন করে মনে করিয়ে দেয় কেন আইন আছে।

হাসপাতালের শীতল করিডোরে শারমিনের যুদ্ধ চলতে থাকে। তার শরীরে মোট বারোটি অস্ত্রোপচার করা হয়। আঙুলে নতুন টান, ঘাড়ে নড়াচড়ার সীমা, ত্বকে অচেনা ভূমিরূপ, আজ ডান হাত তোলা যাবে কাঁধের উচ্চতা পর্যন্ত; কাল এক সেন্টিমিটার বেশি….। গুটমান ইনস্টিটিউটে নয় মাস ধরে রিহ্যাব—ফিজিও, অকুপেশনাল, সাইকোথেরাপি চলতে থাকে।

এদিকে দুই শিশু আরাফ ও আরিশা প্রথমে সামাজিক সেবার তত্ত্বাবধানে চলে যায় নিরাপদ আবাসে। ডিসেম্বর ২০২৩–এ দুই সন্তানই মায়ের হেফাজতে ফিরে আসে। ঘরে প্রথম রাতটিতে আরিশা খাতার পাতায় রঙিন সূর্য এঁকে লিখেছিল: “আম্মুর আলো”। আরাফ চুপচাপ এসে মায়ের ওয়ার্কস্টেশনের চেয়ারটা ঠিক করে দিয়েছিল। সেই বালকসুলভ যত্নে শারমিন বুঝেছিলেন নির্মাণের নকশা এখন তাঁর হাতেই।

আশ্রয়ের ঠিকানাও বদলায়। ২০২৩–২৪-এ শারমিন ছিলেন একটি মহিলা আশ্রয়কেন্দ্রে। ২০২৫ সালে পেয়ে যান সিটি কাউন্সিলের তিন বেডরুমের একটি ফ্ল্যাট। এদিকে বার্সেলোনা সিটি কাউন্সিলের ডাটা এন্ট্রির চাকুরি দেয়া হয় তাকে। বেতন ১,২০০ ইউরো। সরকারি ন্যুনতম আয়ের ভাতা (IMV) হিসেবে যুক্ত হয় মাসে ৪৮০ ইউরো এবং আরও যুক্ত হয় কাতালান সরকারের শিশু ভাতা ৩২০ ইউরো প্রতি মাসে।। এছাড়া ক্ষতিপূরণের কিস্তি আসে নিয়মিত।

আহসান এখন মাদ্রিদের Tejera Prison–এ। তিনি এখন প্রতিদিন সন্ধ্যায় কয়েদখানার আঙিনায় মাথা নিচু করে হাঁটেন।

শারমিনের দিনযাপন এখন এক নতুন ব্যাকরণ। সকালে শিশুদের স্কুলে পৌঁছে দিয়ে তিনি অফিসে যান; অ্যাডাপটিভ ওয়ার্কস্টেশনের সামনে বসে স্প্রেডশিটে ডেটা সাজান। দুপুরে থেরাপির দিন হলে হাসপাতালে; বিকেলে বাসায় ফিরে হোমওয়ার্ক, রান্না। সপ্তাহান্তে কমিউনিটি হলে বৈঠক—অভিবাসী নারীদের জন্য আইনি পরামর্শ, জরুরি সহায়তা, “নীরবতা ভাঙুন” ক্যাম্পেইন।

El País (১৫ মার্চ ২০২৫) পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে শারমিন বলেছিলেন, “আমার শরীরের দাগ আমার লড়াইয়ের ইতিহাস। যখন মেয়ে বলে ‘আম্মু, তোমার পিঠের ড্রাগনগুলো সুন্দর’, আমি বুঝি এই দেহ এখন আশার বাহন।” এই কথার পর শহর যেন নতুন করে তাঁকে গ্রহণ করে; সমুদ্রতটে হাঁটতে গেলে বাতাস যেন তার নাম ধরে ডাকে।

কখনও কখনও ইতিহাস লেখা হয় পাথরে, কখনও কাগজে, কখনও শরীরে। শারমিন সুলতানার শরীরে ইতিহাস লিখেছে আগুনের তাপ, হাসপাতালের শীতলতা, আইনের অক্ষর, আর কমিউনিটি হলের করতালি। কিন্তু যে ইতিহাস শেষ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠা পায়, তার নাম—মানবমর্যাদা। এই মর্যাদা নিয়েই তিনি হাঁটছেন; সমুদ্রের নীলের দিকে, ভবিষ্যতের দিকে যেখানে “বেঁচে থাকা” এবং “বাঁচিয়ে তোলা” দুটি শব্দ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকে। শহর তখন তার পেছনে নয়, পাশে একটি হাত বাড়িয়ে। শারমিন নিজের হাতে সেই হাত ধরেন। আর গল্প চলতে থাকে নীরবে, দৃঢ়ভাবে, আলোর দিকে।



আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরো খবর: