বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিউবো) সারাদেশে বিদ্যুতের অপচয় রোধকল্পে এবং ভুতুড়ে বিলের লাগামহীন হয়রানি থেকে গ্রাহকদের নিস্তার দিতে ২০২৪ সালে বিদ্যুৎ বিল প্রথা বিলুপ্ত করে গ্রাহকের মাঝে প্রিপেইড মিটার বসানোর কার্যক্রম শুরু করে। এই সিস্টেমের আওতায় কক্সবাজারের চকরিয়া পৌরসভা এবং আশপাশের এলাকায় বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) গ্রাহকদের পুরানো মিটার জমা নিয়ে গ্রাহককে নতুন করে প্রিপেইড মিটার সংযোগ দেওয়া শুরু করেছেন। চকরিয়া পিডিবির আওতাধীন বিভিন্ন বাসা-বাড়ি, দোকানপাট ও মার্কেটের ৪০ হাজার গ্রাহকের মধ্যে দেড়বছরে ২২ হাজার গ্রাহকের মাঝে প্রিপেইড মিটার লাগানোর কাজ শেষ করেছে।
এখনো এই সিস্টেমের আওতায় আরও ১৮ হাজার গ্রাহকের মাঝে প্রিপ্রেইড মিটার লাগানোর কাজ বাকি রয়েছে। অবশ্য বর্তমানেও উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় প্রকল্পের সংশ্লিষ্ট লোকজন গ্রাহকের পুরানো মিটার বদলে দিয়ে প্রিপেইড মিটার লাগানোর কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
অভিযোগ উঠেছে, চকরিয়া পিডিবি কতৃক ইতোমধ্যে বিভিন্ন এলাকায় লাগানো ২২ হাজার গ্রাহকের মধ্যে সিংহভাগ গ্রাহক প্রিপেইড মিটার নিয়ে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন। পাশাপাশি নতুন প্রিপেইড মিটার নিতে গিয়ে সংশ্লিষ্টরা নানা কায়দায় টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন বলে অভিযোগ করেছেন।
বেশিরভাগ গ্রাহকের অভিযোগ, প্রিপেইড মিটারে টাকা লোড করার পর নানা কায়দায় অযথা টাকা কেটে নেওয়া হচ্ছে। এছাড়া মিটারে নানারকম অসঙ্গতি নিয়ে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে তাদের। বিশেষ করে মিটারে যথাসময়ে টাকা রিচার্জ করতে না পারা, আবার টাকা লোড করার পর অতিরিক্ত চার্জ, মিটারের ভাড়া এবং অন্যান্য চার্জের নামে একটি বিশাল অঙ্কের টাকা কেটে নেওয়া হচ্ছে। আবার টাকা লোড করতে গিয়ে মিটারে কারিগরি ত্রুটি দেখা দিচ্ছে। অনেক সময় মিটার লক হয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় লক খুলতে বিদ্যুৎ অফিসে গেলে বা লাইসম্যানের দ্বারস্থ হতে গিয়ে সেখানে টাকার মাশুল গুনতে হচ্ছে। এরপরও গ্রাহকরা মিটারের বিলিং প্রক্রিয়া এবং রিচার্জ করার পদ্ধতি নিয়েও চরম বেকায়দায় পড়ছেন বলে অভিযোগ তুলেছেন।
ভুক্তভোগী অনেক গ্রাহক অভিযোগ করে বলেন, প্রিপেইড মিটার স্থাপনের সময় আমাদের পুরানো মিটার বিদ্যুৎ অফিসের লোকজন নিয়ে যায়। কিন্তু সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী শুধুমাত্র মিটার বদল ফ্রি নেয়ার নিয়ম থাকলেও বিদ্যুৎ বিভাগের লোকজন নতুন প্রিপেইড মিটার বাইর থেকে কিনতে হচ্ছে অজুহাত দেখিয়ে আমাদের কাছ থেকে মিটারের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এ বিষয়টি আমরা জানিনা। কিন্তু আমাদেরকে অন্ধকারে রেখে তাঁরা মিটারের টাকা হাতিয়ে নিলেও পরে দেখা যাচ্ছে টাকা লোড করার পর সেখান থেকে মিটার ভাড়া টাকা কেটে নেওয়া হচ্ছে। এখন প্রিপেইড মিটার লাগানোর পরবর্তী আমাদের ভোগান্তির মাত্রা বেড়ে চলছে। বিদ্যুৎ বিভাগের টাকা হরিলুটের এই পদ্ধতি এখন নিরবিচ্ছিন্ন সেবার বিপরীতে আমাদের কাছে গলারকাঁটা হিসেবে উপনীত হয়েছে বলে দাবি করেছেন ভুক্তভোগী গ্রাহকরা।
এ অবস্থায় বেশিরভাগ গ্রাহক প্রিপেইড মিটার বন্ধ করে পোস্টপেইড ও ডিজিটাল মিটার স্থাপনের দাবি জানিয়েছেন। তাঁরা প্রয়োজনে এ বিষয়টি নিয়ে
আন্দোলনে যাবেন বলে হুশিয়ারি দিয়েছেন অনেকে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, চকরিয়া পিডিবি কতৃক
আগের পোস্টপেইড মিটার সরিয়ে নতুন প্রিপেইড মিটার বসাতে গ্রাহকদেরকে নানাভাবে বাধ্য করা হচ্ছে। অথচ এই প্রিপেইড মিটারের ব্যবহার নিয়ে চলছে নানা অব্যবস্থাপনা ও অসঙ্গতি। মিটারে টাকা লোড করার পর কেটে নেওয়া হচ্ছে অতিরিক্ত চার্জ। এমনকি মিটারে রিচার্জ করার পরই দ্রুত টাকা শেষ হয়ে যায়।
গ্রাহকদের অভিযোগ, কাগজের বিলের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি বিল পরিশোধ করতে হচ্ছে প্রিপেইড মিটারে। আবার টাকা শেষ হয়ে গেলে জরুরি ব্যালান্স নিতে গিয়ে দিতে হচ্ছে অতিরিক্ত চার্জ। মিটারে টাকা লোড করতে গিয়ে পোহাতে হচ্ছে নানামুখী ঝামেলা। টাকা রিচার্জ করার সময় একসঙ্গে এতগুলো ডিজিট প্রবেশ করাতে গিয়ে ভুল হলেই মিটার ‘লক’ হয়ে যায়। তখন দীর্ঘ সময় বিদ্যুৎহীন থাকতে হয় গ্রাহকদের। এ অবস্থায় মিটার আনলক করতে দিনের পর দিন ধরনা দিতে হয় সংশ্লিষ্ট বিদ্যুৎ অফিসে। এসব কারণে গ্রাহকেরা প্রিপেইড মিটারের পরিবর্তে আবার পোস্টপেইড মিটার স্থাপনের দাবি জানাচ্ছেন।
ভুক্তভোগী গ্রাহকরা জানিয়েছেন, আগের মিটার গুলো চালু থাকলেও কৌশলে অফিস থেকে মিটার গলো অচল করে দেওয়া হচ্ছে। এভাবে আমাদের অনেকটা জিন্মি করে অযৌক্তিকভাবে প্রিপেইড মিটার লাগিয়ে দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে। চকরিয়া বিদ্যুৎ অফিসের কর্মকর্তা কর্মচারীরা ঠিক আগের মতো গ্রাহকদের সেবা না দিয়ে উল্টো প্রিপেইড মিটার স্থাপনের মাধ্যমে গ্রাহকের টাকা লুটপাট শুরু করেছেন। একমাস প্রিপেইড মিটার ব্যবহার করে দেখা গেছে, আগের মিটারের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি বিল কাটা হচ্ছে।
ভুক্তভোগী গ্রাহকরা জানিয়েছে, বিদ্যুৎ বিভাগের লোকজন তাদের সঙ্গে চুক্তি মতে একটি কোম্পানির মাধ্যমে বিশেষ প্রকল্পের আওতায় ডিজিটাল মিটার স্থাপনের পরিবর্তে প্রি-পেইড মিটার স্থাপনের জন্য স্থানীয় বিদ্যুৎ গ্রাহকদের নানাভাবে চাপ সৃষ্টি করছে।
এ অবস্থায় উপজেলার বিভিন্ন স্থানে প্রি-পেইড মিটার স্থাপন করতে গিয়ে বিদ্যুৎ বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মচারীরা হেনেস্তার শিকার হতে হচ্ছে। তবুও তারা অনেকটা জোর করেই প্রি- পেইড মিটার স্থাপন চালিয়ে যাচ্ছে।
অভিযোগ উঠেছে, প্রি-পেইড মিটার বসাতে গিয়ে লাগানো চার্জ বলে গ্রাহকের কাছ থেকে ৩০০/৫০০ টাকা করে হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এছাড়া লোড বৃদ্ধি করতে নেওয়া হচ্ছে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা।
ফাসিয়াখালী ইউনিয়নের ভুক্তভোগী বিদ্যুৎ গ্রাহক সাংবাদিক সাইফুল ইসলাম খোকন বলেন, ‘আগে আমার বাড়িতে ৬০০-৭০০ টাকার মতো বিল আসত। এখন প্রিপেইড মিটারে ১ হাজার থেকে বারশত টাকা লোড করতে হচ্ছে। তাও মাস শেষ হবার আগে রির্চাজ শেষ হয়ে যায়। তিনি বলেন, এই হরিলুট কী কারণে হচ্ছে, এটা আমার বুঝে আসেনা। আবার লোডশেডিংও বেশি। আমরা আগের মিটার চাই।’ প্রিপেইড মিটারের ভোগান্তির নিস্তার চাই।
ভুক্তভোগী গ্রাহক চকরিয়া পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের কাজিরপাড়া গ্রামের বাসিন্দা বিএনপির সভাপতি শামীম ওসমান বলেন, ৫০০ টাকা মিটারে লোড করার পর ১৬০ টাকা কেটে নেওয়া হচ্ছে। এধরণের লুটপাট তো কাগজের বিল দেয়ার সময় কোনদিন হয়নি। এই টাকা গুলো কারা ভাগবাটোয়ারা করছে, জানতে চাই। তিনি বলেন, ‘আমার একটাই দাবি, প্রিপেইড মিটার খুলে আমাদের আগের মিটারটাই দেওয়া হোক। আমরা তো কখনো টাকা বকেয়া রাখি না। মাস পুরলেই বিলের টাকা দিয়ে দিই।
চকরিয়া বিদ্যুৎ বিভাগ (পিডিবি) সুত্রে থেকে জানা যায়, চকরিয়াস্থ নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয়ের আওতাধীন চকরিয়া পৌরসভা এবং ফাসিয়াখালী ইউনিয়ন, পুর্ববড় ইউনিয়ন আংশিকসহ বিভিন্ন এলাকায় মোট বিদ্যুৎ গ্রাহকের সংখ্যা ৪০ হাজার। তারমধ্যে সরকারি সিদ্ধান্তের আলোকে গত দেড়বছরে ২২ হাজার গ্রাহকের মাঝে প্রিপেইড মিটার দেওয়া হয়েছে বা বসানো হয়েছে। অবশিষ্ট ১৮ হাজার গ্রাহককেও প্রিপেইড মিটার দেয়ার কাজ করছেন বিদ্যুৎ বিভাগের লোকজন।
জানতে চাইলে চকরিয়া বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিউবো) বিভাগের আবাসিক প্রকৌশলী মোহাম্মদ নুরুন্নবী বলেন, প্রিপেইড মিটার হচ্ছে ডিজিটাল সিস্টেমে বিদ্যুৎ সরবরাহ। চকরিয়ায় ইতোমধ্যে ২২ হাজার গ্রাহককে প্রিপেইড মিটার সংযোগ দেওয়া হয়েছে। বেশিরভাগ মিটার ভালো চলছে। তবে নতুন গ্রাহকরা সিস্টেম না বুঝার কারণে কিছু সমস্যা হলেই অভিযোগ গুলো করছেন।
তিনি বলেন, আগের কাগজের বিলে সকল সার্ভিস চার্জ লেখা থাকতো। এখন টাকা লোড করার পর সেখান থেকে একই সার্ভিজ চার্জ সমূহ কাটা হচ্ছে। এখানে অতিরিক্ত চার্জ কাটার সুযোগ নেই। আর প্রিপ্রেইড মিটারে টাকা লোড করতে যেসব অসঙ্গতি দেখা যাচ্ছে, তা নিরসনের জন্য আমরা কাজ করছি। গ্রাহকরা মোবাইল রির্চাজের মতো তাঁর মিটার টাকা লোড করতে পারবে। সেইজন্য বিউবো কতৃপক্ষ ওয়ানস্টপ সুবিধা নিশ্চিত করতে যাচ্ছে।
আবাসিক প্রকৌশলী নুরুন্নবী আরও বলেন, পুরানো মিটার রেখে দিয়ে নতুন প্রিপেইড মিটার লাগানোর ক্ষেত্রে গ্রাহকের কাছ থেকে মিটার কেনার অজুহাতে টাকা নেয়ার সুযোগ নেই। কেউ যদি বিষয়টি নিয়ে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করেন, তাহলে তদন্ত সাপেক্ষে অভিযুক্ত কর্মকর্তা বা কর্মচারীর বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ##