কুয়েত—মধ্যপ্রাচ্যের ছোট্ট একটি রাজতান্ত্রিক দেশ। আয়তনে খুব বেশি নয়, কিন্তু তেলের খনি আর বিশাল তহবিলের কারণে একে বলা হয় “পেট্রো-স্বর্ণভূমি”। এখানকার আকাশে রোদ ঝলমলে থাকে বছরের প্রায় পুরোটা সময়, আর মাটির নিচে রয়েছে কালো সোনা—তেল। সেই তেলের টাকায় গড়ে উঠেছে প্রাসাদ, শপিং মল, আর রেশমি গালিচায় মোড়া রাজকীয় জীবন। তবে এই ঝলমলে জীবনের নিচে এক আড়াল আছে—পরিশ্রমের, ঘামের, আর নিঃশব্দ কান্নার।
সেই নিঃশব্দ কান্নার ভাষা বাংলা, উর্দু, তামিল, মালায়ালাম কিংবা তাগালগো। এই দেশের বিশাল গৃহস্থালি ও নির্মাণব্যবস্থা দাঁড়িয়ে আছে এই ভাষাগুলোর কাঁধে। কুয়েতে বর্তমানে বিদেশি শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৩০ লাখের বেশি, যেখানে স্থানীয় নাগরিক মাত্র ১৫ লাখ। এই বিশাল বিদেশি জনগোষ্ঠীর মধ্যে বাংলাদেশিদের অবস্থান তৃতীয়, ভারত ও মিসরের পর। প্রায় ৪ লক্ষাধিক বাংলাদেশি শ্রমিক এই দেশে কাজ করছে।
পুরুষেরা কাজ করে নির্মাণে, রাস্তার মিস্ত্রি, স্যানিটেশন ও ক্লিনিং কোম্পানিতে, শপিং মলের নিরাপত্তা প্রহরী হিসেবে, কিংবা রেস্টুরেন্টের কিচেন হেল্পার। অনেকে আবার মসজিদের মুয়াজ্জিন, মুদি দোকানের হেল্পার, কিংবা মিউনিসিপালিটির পরিচ্ছন্ন কর্মী হিসেবেও নিয়োজিত। নব্বই দশক থেকে বাংলাদেশ থেকে নারী শ্রমিকরা আসা শুরু করেছে; বিশেষ করে গৃহকর্মী হিসেবে।
বাংলাদেশ থেকে নারীদের গৃহকর্মী হিসেবে এমন সময় থেকে পাঠানো শুরু হয় যখন নির্যাতনের অভিযোগে ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, শ্রীলঙ্কা তাদের নারীদের পাঠানো বন্ধ করে দেয়। সেই শূন্যতা পূরণে এগিয়ে আসে কিছু অসৎ বাংলাদেশি রিক্রুটিং এজেন্সি। তারা বলত—”কুয়েত নিরাপদ, কাজ সহজ, বেতন ভালো”। মেয়েদের পরিবারের কাছে বলত—”পাঁচ মাসেই খরচ উঠে যাবে। মেয়েটা টাকা পাঠাবে, ঘর বানাবেন, ছেলে পড়াবে।” সরকার দেখেও দেখেনি। অভিযোগের পর অভিযোগ করেও লাভ হয়নি। অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ঘুষের টাকায় ছাড়পত্র দিয়ে দিতো খুব সহজে।
এই সব স্বপ্নের নিচে গা ঢাকা দিয়ে বসে ছিল আরেকটা চোরাবালি—কাফালা ব্যবস্থা, যেখানে একজন বিদেশি কর্মী তার কফিল বা স্পনসরের ‘সম্পত্তি’। চাকরি ছাড়তে পারবে না, বাড়ি ফিরতে পারবে না, অভিযোগ জানাতে পারবে না—যদি না কফিল অনুমতি দেন।
এই কাফালা ব্যবস্থার বলি হয়েছে বাংলাদেশের শত শত নারী। কারো মৃত্যু হয়েছে গোপনে, কেউ খুন হয়েছে ‘আত্মহত্যা’র নাম দিয়ে। কেউ কেউ নিখোঁজ হয়েছে, কারো লাশ ফেরে পলিথিনে মোড়ানো কফিনে। কেউ ফেরেই না। তবে একজন ফিরেছিলেন।
প্রথম রাতেই শুরু হয় গৃহকর্তার স্পর্শ। দ্বিতীয় রাতে শুরু হয় ধর্ষণ। তারপর নিয়মিত। গৃহকর্তা, তার বড় ছেলে, মাঝেমাঝে ছোট ছেলেও। কেউ পছন্দের কিছু না পেলে ঠেলে দিত দেয়ালে, পেটাত। একবার কফিতে চিনি কম দেওয়ায় গরম পানি ছুঁড়ে দেওয়া হয়েছিল তার গালে। পিঠে জ্বলন্ত লোহার দাগ—একটা নয়, অনেকগুলো। রেহানা শিখে নেয়—চুপ থাকাটাই বাঁচার উপায়।
ধর্ষণের পর ক্ষতস্থানে লবণ পানি ঢালা হতো। বলা হতো জীবাণু মরবে। আসলে ওরা উপভোগ করত সেই যন্ত্রণার আর্তনাদ। ঘুম ৪ ঘণ্টার বেশি কখনো হয়নি।
২০২০ সালের ১৫ জুন। গৃহকর্তার ১৭ বছরের ছেলে সেদিন রাতে তার দুই বন্ধুকে ডাকে। রাতভর পালাক্রমে ধর্ষণ করে ভিডিও তোলে চলে যায়।
রেহানা বাথরুমে ঢুকে। হঠাৎ তার চোখ যায় জানালার পাশে এক কোনায় রাখা এক বোতল প্যারাকোয়াট (Paraquat)—আগাছানাশক মারাত্মক রাসায়নিক। ওই বোতল, সেই রাত্রি, আর এক ক্ষতবিক্ষত নারী—এই তিনটি উপকরণ মিলে তৈরি হয় এক প্রতিশোধের বিষ। সে বিষ মিশিয়ে দেয় গৃহকর্তার পরিবারের সকালের খাবারে। অল্পক্ষণেই গৃহকর্তা, তার স্ত্রী, এবং বড় ছেলে মারা যায় বমি আর রক্তক্ষরণে।
তার শরীরে ছিল ২৭টি ক্ষতচিহ্ন। মেডিকেল রিপোর্টে উল্লেখ থাকে—যৌনাঙ্গের মারাত্মক ক্ষত, পিঠে লোহার ছ্যাঁকা, পায়ের নিচে পিষে ফেলার দাগ।
কুয়েতের আদালতে প্রথম দিনেই সাংবাদিকেরা জড়ো হয়। কারণ ঘটনা ছিল ব্যতিক্রম: এক বিদেশি নারী, গৃহকর্মী, তিনজন আরব নাগরিককে হত্যা করেছে, তাও নিজে থানায় গিয়ে স্বীকারোক্তি দিয়ে। দেশজুড়ে আলোচনা ছড়িয়ে পড়ে।
রেহানার হয়ে দাঁড়িয়েছিল এক কুয়েতি মানবাধিকার আইনজীবী—মারওয়া আল-আনজারি। তিনি আদালতে বলেছিলেন, “ও হত্যাকারী নয়, সে নির্যাতনের ইতিহাসে একটি পৃষ্ঠামাত্র।” আদালতে যখন মেডিকেল রিপোর্ট পেশ করা হয়—তখন নীরবতা নেমে আসে। ডাক্তার বলেন, “ওর শরীর একটা যুদ্ধক্ষেত্র। কোথাও কাটা, কোথাও দগদগে পুড়েছে, কোথাও গভীর ক্ষত। সে বেঁচে আছে—এটাই বিস্ময়।”
আদালত আর্টিকেল ১৫৩-এর আওতায় রেহানার কাণ্ডকে “অস্থায়ী পাগলামি” হিসেবে চিহ্নিত করে। রায় আসে: “তিন বছরের কারাদণ্ড।”
গৃহকর্তার পরিবারের তরফে দাবি করা হয়েছিল রক্তপণ—এক মিলিয়ন দিনার। কিন্তু আদালত তা নাকচ করে দেয়। যুক্তি ছিল: “এই নারী মানুষ মারেনি, সে শুধুই একটা ব্যবস্থা ধ্বংস করেছে—যা তাকে মেরেছিল প্রতিদিন।” রেহানার গৃহকর্তার ছোট ছেলে, যিনি বেঁচে গিয়েছিলেন, এখন সে পুরো বাড়ির মালিক। তার বিরুদ্ধে কোনো মামলা হয়নি। কারণ, আইনি কৌশলে সে “minor” বলে ছাড়া পেয়ে যায়।
কুয়েতের সেন্ট্রাল কারাগারে রেহানা ছিলেন ২০২০ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত। সেখানেও প্রথমে তাকে ‘খুনি’ হিসেবে আলাদা রাখা হয়েছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে জেলখানার অন্য বন্দিরা, বিশেষ করে অন্য বাংলাদেশি ও দক্ষিণ এশীয় গৃহকর্মীরা বুঝে যায়, এই নারী তাদের প্রতিনিধি—এক প্রতিবাদী শরীর।
অনেকেই তার কাছে নিজের গল্প বলতে শুরু করে। কেউ বলত কানের পাশে ছুরি চালানোর কথা, কেউ বলত রাতের আঁধারে ধর্ষিত হবার কথা, আবার কেউ বলত তাদের ফেরার স্বপ্ন কিভাবে ঝুলে আছে কফিলের অনুমতির দড়িতে।
২০২৩ সালের মার্চ মাসে বাংলাদেশ দূতাবাসের সহায়তায় রেহানার জন্য ট্রাভেল ডকুমেন্ট তৈরি হয়। ফেরার ফ্লাইটে উঠেছিলেন রেহানা নিঃসঙ্গ এক যাত্রী হয়ে। হাতে ছিল না কোনো ব্যাগ, ছিল না কোনো লাগেজ, পকেটে ছিল না এক পয়সাও। শুধু বুকের গভীরে ছিল কুয়েতের তিন বছরের রক্তাক্ত ইতিহাস, এবং সন্তানদের জন্য চেপে রাখা এক গোপন অনুতাপ—যা ভাষায় বলা যায় না, চোখেও ধরা পড়ে না, শুধু হৃদয়ে জ্বলে।
বিমানবন্দরে নামার পর, রেহানাকে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকার একটি সেফ হাউজে। সেখান থেকে শুরু হয় তার শারীরিক ও মানসিক চিকিৎসা। বর্তমানে তিনি BRAC-এর রিকভারি প্রোগ্রামে আছেন। তার দুই সন্তান স্থানীয় স্কুলে পড়ে। তাদের জন্য সরকারি অনুদানও চালু হয়।
রেহানা পারভীনের গল্প কোনো কল্পকাহিনি নয়। এটি এক বাস্তব যুদ্ধ, এক শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ। সে শুধু মরেনি, সে নিজে বাঁচার জন্য লড়েছে। আর তার সেই লড়াইয়ে অনেক রেহানার ভিতর সাহসের এক আগুন জ্বলে উঠেছে।
রেহানার ঘটনা কুয়েতের কাফালা সিস্টেমের বিরুদ্ধে একটি বিস্ফোরণ হয়ে দাঁড়ায়। Amnesty International ও Human Rights Watch পৃথকভাবে দুটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। নাম দেয়—”I Was Sold in Kuwait” এবং “Contract of Slavery”। আল-আমিন ম্যানপাওয়ার এজেন্সি এখনো মোহাম্মদপুরে চলছে—নতুন নামে, পুরনো চেহারায়।