শিরোনাম ::
১৫ আগস্টের প্রেক্ষিতে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের চেষ্টা করলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা বিপৎসীমার ওপরে তিস্তার পানি, লালমনিরহাটে ২০ হাজার মানুষ পানিবন্দি বাংলাদেশ সফরে আসছেন এএফসি সভাপতি সালমান বিন ইব্রাহিম নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার অধিকার কারও নেই মেয়াদ বাড়ল প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দারের জামিনে কারামুক্ত হলেন অভিনেত্রী শমী কায়সার দুই দিনের ব্যবধানে ঢাকা সফ‌রে আসছেন পাকিস্তানের বাণিজ্য ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী চকরিয়ায় বাড়ির পাশে জলাশয়ের পানিতে ডুবে শিশুর মৃত্যু জামিনে মুক্তি পেলেন আ.লীগের সাবেক মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ বার্মিংহামের আকাশে যে গল্প ভেসে বেড়ায়
August 15, 2025, 3:44 am
নোটিশ::
আমাদের নতুন ডোমেইনে আপনাকে স্বাগতম, কক্সবাজার পোস্ট ডটকমের জনপ্রিয়তাকে পুজিঁ করে অনেক নতুন ফেইসবুক পেইজ খোলা হয়েছে,তাদের কার্যকলাপের জন্য আমরা দায়ী নয়  

বার্মিংহামের আকাশে যে গল্প ভেসে বেড়ায়

প্রতিবেদকের নাম:
আপডেট: বৃহস্পতিবার, আগস্ট ১৪, ২০২৫


সাদিকার কল্পিত ছবি

নভেম্বরের এক সন্ধ্যা। বার্মিংহামের আকাশে ধীরে ধীরে নামছে কুয়াশার পর্দা, যেন কোনো অদৃশ্য শোকের ছায়া ঢেকে দিচ্ছে গোটা শহরকে। গাছপালার ভেজা ডালপালা, হলুদ হয়ে যাওয়া পাতার ঝরাপড়া শব্দ, আর নার্সিং হোমের করিডোরে হুইলচেয়ারের ধীর গতির আওয়াজ—সবকিছু মিলেমিশে এক অজানা অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে। ঠিক এই আবহেই, এক শান্ত নার্সিং হোমের নিঃশব্দ দেয়ালের আড়ালে ঘটছিল কিছু ভয়ানক—যা কেবল মৃত্যুর নয়, বরং অভিমান, যন্ত্রণা ও অবজ্ঞার এক দীর্ঘশ্বাসময় ইতিহাস। এখানেই, একটি তথাকথিত নিরাপদ আশ্রয়ে, নিভে গেছে আটটি জীবন—যারা শেষ বয়সে চেয়েছিল শুধু একটু যত্ন, একটু সম্মান, আর একটু শান্তিময় বিদায়।

এই আটজন শুধুই বৃদ্ধ ছিলেন না—তারা ছিলেন ইতিহাসের জীবন্ত সাক্ষ্য। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে ও পরে, ১৯৬০ থেকে ৯০-এর দশকের মধ্যে তাঁরা এসেছিলেন যুক্তরাজ্যে—কেউ শ্রমিক হিসেবে, কেউ কারখানার কর্মী, কেউ ট্যাক্সি চালক, কার্পেন্টার, আবার কেউ রেস্টুরেন্টের কর্মচারী হিসেবে। ভাষা জানতেন না, রাস্তা চিনতেন না, তবু জীবনের ঝুঁকি নিয়েই ঢুকে পড়েছিলেন এক অচেনা নতুন সভ্যতার ভেতর। কোনো দিন তাঁরা রাতভর প্যাকিং ফ্যাক্টরিতে শিফট করেছেন, কোনো দিন বাস ডিপোর শেষ ট্রিপে দাঁড়িয়ে ছিলেন ক্লান্ত শরীরে। খাওয়া-ঘুমের ত্যাগ, শরীরের কষ্ট—সবকিছু উপেক্ষা করে পরিবারের জন্য পাঠিয়েছেন রোজগারের শেষ পয়সাটুকু। কেউ কেউ শীতের দিনে নিজের ঘরে হিটিং না চালিয়ে, বিদ্যুৎ বিল বাঁচিয়ে, সেই অর্থ পাঠিয়েছেন দেশে—সন্তানদের পড়াশোনার জন্য, অসুস্থ মায়ের ওষুধ কেনার জন্য।

তাদের ঘাম আর পরিশ্রমে গড়ে উঠেছে ব্রিটেনের বহু রাস্তা, কারখানা, রেস্টুরেন্ট। তারা হয়তো কোনো স্মৃতিফলকে নেই, কিন্তু প্রতিটি বাংলাদেশি পরিবার যারা আজ যুক্তরাজ্যে স্বাচ্ছন্দ্যে বসবাস করে—তাদের পেছনে আছে এই আটজনের মতো শত শত মানুষের আত্মত্যাগ।

আর সেই মানুষগুলোর শেষ ঠিকানা হলো বৃদ্ধাশ্রম—যেখানে চা’য়ের কাপ ঠাণ্ডা হয়ে যায় ছুঁয়ে দেখার আগেই, কিংবা পুরোনো দিনের কথা বলতে বলতে মুখ থেমে যায় হঠাৎ। বৃদ্ধাশ্রমে তারা খুঁজেছিলেন একটু যত্ন, একটু ভালোবাসা, একটু নিঃশব্দ শান্তি। অথচ সেই শান্তি এসে মিশেছে এক নার্সের হাতে বিষাক্ত ইনজেকশনে।

তারা মরেননি শুধুমাত্র বার্ধক্য বা রোগে। তারা মরেছেন অবহেলায়, অবিশ্বাসে, আর সেই বিশ্বাসঘাতক হাতের ছোঁয়ায়—যার ওপর পরিবারগুলো আস্থা রেখেছিল জীবনের শেষ অধ্যায়ে।

এজবাস্টনের ‘গ্রোভ নার্সিং হোম’—একটি শান্ত, সবুজ পরিবেশে অবস্থিত প্রবীণদের আশ্রয়স্থল। বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই, ভিতরে কী ঘটছে। দুধ-সাদা ইউনিফর্মে ধীরে ধীরে ঘুরে বেড়াতেন একজন নার্স—নাম সাদিকা পারভিন। খুব সুন্দর করে কথা বলতেন, রোগীদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন, খাবার তুলে দিতেন। কিন্তু এই কোমলতার পেছনে ছিল এক অদ্ভুত নৃশংসতা—যার হিসাব পরে খোলা হয় রক্তের পরীক্ষায়, আদালতের কাঠগড়ায়।

প্রমাণিত ৪ জনের মৃত্যুর গল্প
বদরুদ্দিন আব্দুল্লাহ (৭৫) — সিলেট থেকে ১৯৭০-এর দশকে আসা এই বৃদ্ধ মানুষটি ছিলেন বার্মিংহামের একটি মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা। মাথায় টুপি, হাতে তসবি—তাঁর জীবন ছিল শান্তির সাধনায় নিবেদিত। ছেলেরা তাঁকে এখানে রেখে নিশ্চিন্ত ছিলেন। এক রাতে, হঠাৎ করে তিনি মারা যান। নার্সিং হোম বলল—”স্বাভাবিক মৃত্যু”। কিন্তু কেন রক্তে ইনসুলিন এত বেশি ছিল?

আব্দুস শাহিদ (৮০) — সিলেটের বালাগঞ্জ থেকে আগত এই মানুষটি সারা জীবন শ্রম দিয়ে পাউন্ড জমিয়েছিলেন। শেষ বয়সে চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হলেও, মনের দৃষ্টি ছিল তীক্ষ্ণ। তাঁর ছেলে আদালতে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, “বাবা বলতেন—এই নার্সটা কেমন জানি… ঠাণ্ডা চোখ।” এখন সেই ঠাণ্ডা চোখেই লুকিয়ে ছিল মৃত্যু।

আলী আব্বাস (৭৯) — মৌলভীবাজারের শান্ত একটি গ্রাম থেকে আসা মানুষটি ছিলেন একজন অবসরপ্রাপ্ত পোস্টম্যান। বার্মিংহামের রাস্তাগুলো তিনি চিনতেন তাঁর হাতের রেখার মতো। কিন্তু নিজের ঘরের বিছানায় বসে তিনি বুঝতে পারেননি, প্রতিদিনের ইনজেকশনই একদিন তাঁর জীবনের শেষ বিন্দু হয়ে দাঁড়াবে।

আমিনা বেগম (৬৮) — এক সময়ের হাস্যোজ্জ্বল, সংগীতপ্রেমী এই নারী, যিনি তার স্বামীর সঙ্গে আশির দশকে ব্রিটেনে আসেন, জীবনের শেষ সময়ে ভুগছিলেন মনমরা ও অসুস্থতাজনিত বিষণ্নতায়। তাঁর কন্যা বলেছিলেন, “মায়ের রক্তে কোনোদিন ইনসুলিন ছিল না। মৃত্যুর পরে হঠাৎ এলো কোথা থেকে?”

জাহানারা বেগম (৭৫) — মৌলভীবাজার থেকে আসা এই নারী আশির দশকে পরিবারের সঙ্গে যুক্তরাজ্যে আসেন। মৃত্যুর আগে একাধিকবার অভিযোগ করেছিলেন যে নার্স তাকে “অদ্ভুত ইনজেকশন” দিচ্ছে। পোষ্টমর্টেমে তার রক্তে ইনসুলিন পাওয়া যায়।

আব্দুল মতিন (৮৩) — হবিগঞ্জের সন্তান, যিনি ১৯৬৫ সালে ছেলের সঙ্গে যুক্তরাজ্যে আসেন। ২০০৪ সালের এপ্রিলে তিনি হঠাৎ মারা যান “শ্বাসকষ্টে”, যদিও মেডিকেল রেকর্ডে এমন কোনো ইতিহাস ছিল না। তাঁর নাতি বলেছিলেন, “দাদু সুস্থ ছিলেন, এভাবে মারা যাওয়া কিছুতেই স্বাভাবিক নয়।”

ফাতেমা খাতুন (৭১) — সুনামগঞ্জ থেকে আগত এই নারী নব্বইয়ের দশকে মেয়ের সঙ্গে যুক্তরাজ্যে আসেন। “স্ট্রোক” বলে মৃত্যুর কারণ লেখা হয়, কিন্তু পরবর্তীতে তার রক্তে ইনসুলিনের চিহ্ন পাওয়া যায়। তার মেয়ে নাজমা পুলিশে অভিযোগ করেছিলেন, কিন্তু প্রত্যক্ষ প্রমাণের অভাবে মামলা গঠন হয়নি।

এই ৪ জনের মৃত্যু “সন্দেহজনক” হলেও, ফরেনসিক প্রমাণের ঘাটতি এবং নার্সিং হোমের রেকর্ড অপর্যাপ্ততার কারণে আদালতে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করা সম্ভব হয়নি। পুলিশ রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, সাদিকা পারভিন এই ৪ জনের ডিউটি রোস্টারে ছিলেন, কিন্তু সাক্ষ্য বা ডিজিটাল রেকর্ড (যেমন: সিসিটিভি ফুটেজ) না থাকায় তদন্ত বন্ধ হয়ে যায়।

Birmingham Mail ২০১০ সালে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে—“Unsolved Mysteries of Grove Nursing Home”—যেখানে এই চারটি মৃত্যুর নেপথ্য নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। BBC Asian Network-এর ২০১১ সালের একটি রেডিও ইন্টারভিউতে পরিবারের সদস্যরা পুনরায় মামলা খোলার দাবি জানান।

২০১০ সালে আদালত সাদিকার বিরুদ্ধে চারটি হত্যার দায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ঘোষণা করে। বিচারক বলেন, “আপনি এমন একজন মানুষ ছিলেন যাঁর ওপর মানুষ নির্ভর করতো, অথচ আপনি সেই বিশ্বাসেরই খুন করেছেন।”

সাদিকার জন্ম ১৯৭০ সালে, বাংলাদেশের হবিগঞ্জ জেলায়। তার পরিবার আশির দশকে ব্রিটেনে পাড়ি জমায়। লেখাপড়ায় ভালো, শান্ত মেয়ে হিসেবে পরিচিতি। পরে নার্সিং প্রশিক্ষণ নেন বার্মিংহামের একটি প্রতিষ্ঠানে।

সাদিকা আদালতে সরাসরি অপরাধ স্বীকার করেনি। তবে মনস্তাত্ত্বিক রিপোর্টে উল্লেখ ছিল—তার ভেতরে ছিল এক ধরণের ‘সর্বময় কতৃর্ত্বের আকাঙ্ক্ষা’। সে রোগীদের মৃত্যু তার নিজ হাতে নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছিল।

তার স্বামী এবং দুই সন্তান বিচারের সময় কোনো সমর্থন জানায়নি। আদালতে তাদের উপস্থিতিও ছিল না। সাদিকা ছিলেন একা—নিজের অপরাধে, নিজের নীরবতা নিয়ে।

পরবর্তীতে এক তদন্তে জানা যায়, গ্রোভ নার্সিং হোম অনেক অভিযোগ লুকিয়েছে। রেকর্ডস গোপন করেছে, অনিয়মিত ইনজেকশন প্রয়োগের তথ্য এড়িয়ে গেছে। পরে এই নার্সিং হোমটি চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়। যুক্তরাজ্যে ইনসুলিন ম্যানেজমেন্টের ওপর নতুন নিয়ম ও প্রশিক্ষণ চালু করা হয়।

ব্রিটেনের নার্সিং হোমগুলো হয়তো আবার গড়ে উঠবে। নতুন নার্স আসবে, নতুন নিয়ম তৈরি হবে। কিন্তু বদরুদ্দিন, শাহিদ, আমিনা বা আলী আব্বাস আর ফিরবেন না।

তাদের গল্প, এখন শুধুই কুয়াশায় ভেসে বেড়ায়—বার্মিংহামের আকাশে, আর ইতিহাসের সেই অপ্রকাশিত পাতায়—যেখানে লেখা রয়েছে এক নার্সের হাতে নিভে যাওয়া আটটি প্রাণের মর্মান্তিক পরিণতি, আর বিশ্বাসঘাতকতার শেষ নিঃশ্বাস।



আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরো খবর: