অ্যারিজোনার মরুভূমিতে সকাল আসে ছুরি-কামানের মতো তীব্র আলো নিয়ে। সূর্য উঠে যেন গ্লেনডেলের কংক্রিটের দেয়ালগুলোতে আগুন বুলিয়ে যায়। বাতাসে উড়ে বেড়ায় ধুলোর গন্ধ, আর দূরে পাহাড়ের গায়ে সূর্যের ছায়া পড়ে, ঠিক যেন কে যেন এক ছিন্নভিন্ন মানবজীবনের কাহিনি আঁকছে সেই পাথরে।
এই মরুপ্রান্তরে, এই বিষাক্ত পরিপাটি শহরে বাস করত নিশাত আলী। বাংলাদেশি-আমেরিকান এক সুন্দরি তরুণী। সে হাঁটতো মাথা উঁচু করে, যার চোখে ছিল সূর্যের মতো দীপ্তি, আর কণ্ঠে ছিল স্বাধীনতার ঝংকার।
বাবা হাফিজুর রহমান ছিলেন এক কঠোর, ধর্মপরায়ণ, রক্ষণশীল অভিবাসী। মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘ শ্রমজীবনের পর পরিবারসহ গ্লেনডেলে স্থায়ী হয়েছেন ৯০-এর দশকে। কিন্তু তার মানসিকতা থেকে যায় এক অদৃশ্য শিকলে বাঁধা।
নিশাত ছোটবেলা থেকেই উজ্জ্বল। ইংরেজি তার দ্বিতীয় ভাষা হয়ে ওঠে খুব সহজেই। স্কুলে তার বন্ধুর সংখ্যা ছিল বিশাল, অথচ পরিবারের মধ্যে সে ছিল একা। মা রিজওয়ানা বেগম ছিলেন শান্ত ও আত্মবিসর্জনের প্রতীক—চোখের জল গোপন করতেন রান্নাঘরের স্টিলের পাত্রে।
অ্যারিজোনার মুন ভ্যালি হাই স্কুলে (Moon Valley High School) পড়াশোনা করে এবং পশ্চিমা সংস্কৃতিতে সম্পূর্ণভাবে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। সে পড়াশোনায় ভালো ছিল, নাটকে অভিনয় করতো, আর গান গাইত। কিন্তু সমস্যা তৈরি হয় যখন সে প্রেমে পড়ে। ছেলেটির নাম রিকার্ডো। এক মেক্সিকান তরুণ, মার্জিত ও মুক্তচিন্তার মানুষ। তার মা অ্যালিনা নিশাতকে নিজের মেয়ের মতোই আপন করে নিয়েছিলেন।
এ সম্পর্কের কথা বাবা হাফিজের কানে যায়। তার চোখে ছিল এটা পাপ, ছিল এক অভিশাপ। “আমার মেয়ে আমেরিকার বখে যাওয়া কালচারে ডুবে গেছে,”—তিনি আক্ষেপ করতেন বন্ধুদের কাছে।
২০০৯ সালের ২০ অক্টোবর। সকালটা ছিল শান্ত। নিশাত আর অ্যালিনা যাচ্ছিলেন পিয়োরিয়া পাবলিক লাইব্রেরিতে। পার্কিং লটে দাঁড়িয়ে তারা হাসছিলেন—সেই হাসি ছিল নির্ভার, মুক্ত। হঠাৎ, এক কালো জিপ ধেয়ে আসে তাদের দিকে।
চালকের আসনে ছিলেন হাফিজুর রহমান। মুখে কোনও ভাবান্তর নেই। গাড়ির গতি বাড়িয়ে দেন। চাকা চলে যায় নিশাতের শরীরের ওপর দিয়ে। পিঠ ভেঙে যায়, মাথায় আঘাত, শরীর রক্তে রঞ্জিত। অ্যালিনা ছিটকে পড়েন। গাড়িটি দ্রুত পালিয়ে যায়। কিন্তু ঘটনাস্থলে রয়ে যায় মরুভূমির রুক্ষ বাতাসে ছড়িয়ে পড়া নিশাতের আর্তনাদ।
হাসপাতালে নিশাত কোমায় চলে যায়। ১৩ দিন কেবল মেশিনে বেঁচে ছিল সে। মা পাশে বসে ছিলেন, চুলে বিলি কাটছিলেন আর ফিসফিস করে দোয়া পড়ছিলেন। রিকার্ডো আর অ্যালিনা বারবার চোখ মুছতেন, বারবার ভাবতেন—“ও হয়তো চোখ খুলবে।” কিন্তু ২ নভেম্বর, সেই মরুর গহীন রাতে, নিশাতের হৃদস্পন্দন থেমে যায়।
হাফিজুর রহমান সেই ঘটনার পর পালিয়ে যান। মেক্সিকো হয়ে যুক্তরাজ্যে প্রবেশের চেষ্টা করেন। কিন্তু হিথ্রো বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন কর্মকর্তারা তাকে চিনে ফেলেন। ইন্টারপোলের মাধ্যমে তাকে ফিরিয়ে আনা হয় অ্যারিজোনায়। তার বিরুদ্ধে মামলা হয় Second-Degree Murder এবং Aggravated Assault-এর অভিযোগে।
শুনানি শেষে হাফিজুর রহমানকে ৩৪ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। মামলাটি মার্কিন ইতিহাসে অন্যতম প্রথম “Honor Killing” হিসেবে আইনি স্বীকৃতি পায়।
নিশাতকে সমাহিত হয় অ্যারিজোনার একটি সমাধিক্ষেত্রে। তার কবরের পাথরে লেখা:
Nishat Ali (1987–2009)
“She lived with love. She died for freedom.”
এই ঘটনাটি অপরা উইনফ্রে শো-সহ বিভিন্ন টক শোতে আলোচিত হয়।