শিরোনাম ::
চকরিয়ায় শশুর বাড়িতে যাবার পথে অস্ত্রের মুখে আটকিয়ে সেনা সদস্য ও তাঁর স্ত্রীকে মারধর, সর্বস্ব ছিনতাই চরম অব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে কক্সবাজারে পর্যটন উন্নয়নে প্রমোশনাল পরিকল্পনা কর্মশালা অনুষ্ঠিত রামুতে ২৪ হাজার পিস ইয়াবাসহ বিজিবির হাতে আটক ১ বাপের বাড়ি থেকে ফেরার একদিন পর চকরিয়ায় ভাড়া বাসা থেকে গৃহবধূর মরদেহ উদ্ধার শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে উখিয়ায় মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের যুবদের নাগরিক সাংবাদিকতা বিষয়ক প্রশিক্ষণ সম্পন্ন রামুতে সমাজ পরিবর্তনে কিশোর কিশোরীদের ভূমিকা নিয়ে কর্মশালা রামুতে মামলা প্রক্রিয়া নিয়ে পুলিশের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ চকরিয়ায় উন্নয়ন কাজের অগ্রগতি পরিদর্শন ও নতুন সড়ক উদ্বোধন করলেন জেলা প্রশাসক পেকুয়ায় তিন যুগ পর স্থানীয়দের উদ্যোগে রাস্তা সংস্কার
বুধবার, ২৩ জুলাই ২০২৫, ১১:০৯ অপরাহ্ন
নোটিশ::
কক্সবাজার পোস্ট ডটকমে আপনাকে স্বাগতম..  

মাইলস্টোন ট্র্যাজেডি ও একজন মাহরিন চৌধুরী

প্রতিবেদকের নাম:
আপডেট: বুধবার, ২৩ জুলাই, ২০২৫


শিক্ষক মাহরিন চৌধুরী

ঢাকার সকালটা সেদিন অস্বাভাবিক রকম শান্ত ছিল। রোদেলা হলেও গুমোট, আষাঢ়ের ভেজা বাতাস তখনো শহরের গায়ে লেগে ছিল। উত্তরা দিয়াবাড়ির পথে যে মেট্রোরেল হু হু করে ছুটে যাচ্ছিল, তার নীচে ছায়াঘেরা রাস্তায় জেগে উঠছিল একেকটি স্কুলভ্যান, একেকটি ব্যস্ত পায়ের ছাপ। জানালা গলে বয়ে যাওয়া সকালের হাওয়ায় কেউ টের পায়নি—এই সকাল আর ফিরবে না তাদের জীবনে।

সকাল ৭টা ৫০ মিনিট। স্কুলে বেজে ওঠে প্রথম ঘণ্টা। শিশুরা ক্লাসে যায়, বই খোলে, শিক্ষক-শিক্ষিকারা ক্লাস নেওয়া শুরু করেন। মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রাথমিক শাখায় সে সময় ক্লাস করছিল তৃতীয় শ্রেণির সামিয়া, চতুর্থ শ্রেণির আনিশা, সপ্তম শ্রেণির উক্য সাইনসহ শত শত শিশু। আর স্কুল গেটের বাইরে অভিভাবকেরা অপেক্ষায়, কখন ছুটি হবে—তাদের আদরের সন্তানদের নিয়ে ঘরে ফিরবেন।

ঠিক এমন সময় স্কুলের প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে ছিলেন কো-অর্ডিনেটর মাহরিন চৌধুরী। বয়স ৪২। শিক্ষার্থীদের নিরাপদে গেট পার করানো, ছুটি শেষের প্রস্তুতি—সবকিছুই ছিল তার নজরদারিতে। যিনি শুধু একজন শিক্ষকই ছিলেন না, ছিলেন মমতাময়ী অভিভাবকের মতো। হাসিমুখে সব শিশুর নাম জানতেন, তাদের স্বপ্নের কথা জানতেন।

দুপুর ১টা ৬ মিনিট। কুর্মিটোলা বিমানঘাঁটি থেকে আকাশে ওড়ে একটি চীনা তৈরি F-7 BGI প্রশিক্ষণ বিমান। এটি ছিল ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মোহাম্মদ তৌকির ইসলামের প্রথম একক ফ্লাইট। আকাশে উঠেই মাত্র ৪৫ সেকেন্ডের মাথায় কন্ট্রোল রুমে পাঠানো হয় বার্তা: “মেইনটেনেন্স ইমার্জেন্সি।” পাইলট তৌকির ঘুরিয়ে ফেলেন বিমান, খোঁজেন খোলা জায়গা। কিন্তু ঢাকা শহরের এই ঘিঞ্জি এলাকায় কোথায় খোলা আকাশ?

ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মোহাম্মদ তৌকির ইসলাম

দুপুর ১টা ৮ মিনিট। বিকট শব্দে আকাশ থেকে ছুটে এসে ধাক্কা খায় যুদ্ধবিমানটি স্কুল ভবনের ছাদে। মুহূর্তেই আগুনের ফুলকিতে চারপাশ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শ্রেণিকক্ষ, বারান্দা, হলরুম, ক্যানটিন—সব লেলিহান আগুনে ঢেকে যায়। শিশুরা চিৎকার করছে, জানালা দিয়ে লাফ দিচ্ছে, কেউ পুড়ে যাচ্ছে, কেউ নিস্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে চিরতরে।

সেই মুহূর্তেই এগিয়ে আসেন মাহরিন চৌধুরী। নিজের জীবন বিপন্ন করে শিশুদের রক্ষা করতে শুরু করেন তিনি। একের পর এক জানালা দিয়ে ঠেলে দেন শিক্ষার্থীদের। উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থী ফাহিম খান বলেন, “আমি সামনে গিয়ে দেখি এক ম্যাম আগুনে পুড়ে যাচ্ছে, কিন্তু তখনো তিনি কয়েকজন শিশুকে বুকে আগলে রেখেছেন। শিশুরা তেমন কিছু না হলেও ম্যামের পুরো পিঠ পুড়ে গেছে। আমি নিজে দুজনকে বের করে নিয়ে যাই, পরে শুনি ম্যামকেও হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।”

১টা ২২ মিনিটে ফায়ার সার্ভিসের প্রথম ইউনিট আসে। তাদের একজন কর্মকর্তা বলেন, “জানালা দিয়ে তখনও শুনছিলাম—‘আম্মু! বাঁচাও!’ এমন দৃশ্য জীবনে দেখিনি।”

শুধু আগুন না, ধোঁয়াও ছিল মৃত্যুর কারণ। PVC পাইপিং থেকে নির্গত বিষাক্ত গ্যাসে বহু শিশু অজ্ঞান হয়ে পড়ে। অনেকের দম বন্ধ হয়ে মৃত্যু হয়। ক্লাসরুমের ছাদ ছিল দুর্বল, ছাদে ছিল না কোনো আগুন নিবারণ ব্যবস্থা, জরুরি নির্গমন পথ ছিল স্টোররুমে রূপান্তরিত। স্কুল কর্তৃপক্ষ বারবার দাবী করেছিল, “সব নিরাপদ।” কিন্তু বাস্তবে ছিল মৃত্যুর ফাঁদ।

এখানেই শেষ নয়। অভিভাবকরা অভিযোগ করেন—তাদের সন্তানদের হাসপাতালে নিতে বারবার বাধা দেওয়া হয়। সামিয়া নামের এক শিশুর বাবা আব্দুর রহিম বলেন, “আমি নিজে জানালার গ্রিল ভেঙে মেয়েকে টেনে এনেছি। মুখে আগুন, চোখে ছাই। কিন্তু ভিড় ঠেলে হাসপাতালে পৌঁছাতে সময় লাগে ৫০ মিনিট। কেউ সাহায্য করেনি।”

বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ছেঁড়া জামা, পুড়ে যাওয়া শরীর, কান্না আর হাহাকার। একজন অভিভাবক বলেন, “মেয়েকে পাইনি। তালিকা কিছুই দেয় না। শুধু বলে—চিনে নিন।”

মেয়েকে রক্ষায় ছুটে গিয়ে জীবন দিলেন রজনী খাতুন। যদিও তার মেয়ে অন্যদের সহায়তায় বাইরে বেরিয়ে আসে।
প্রতিদিনের মতো সোমবার দুপুরেও স্কুল থেকে ছেলেকে আনতে যান আফসানা আক্তার টিয়া (২৮)। কিন্তু ছেলে একা বাসায় ফিরলেও ফেরেননি মা আফসানা।

রাজনীতিবিদদের ভিড় নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অনেকে। ”তাদের তো এখানে কাজ ছিল না। তারা ছবি তুলতে এসেছিলেন। উল্টো তাদের প্রটোকল দিতে গিয়ে উদ্ধার কাজ বাধাগ্রস্ত হয়েছে।”

এই দুর্ঘটনা যেন শুধু একটি বিমানের পতন নয়—এটি যেন রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থাপনার, উপেক্ষার, এবং উপনিবেশিক মানসিকতার একটি বাস্তব প্রতিচ্ছবি। যেখানে যুদ্ধবিমানের নিচে বেসামরিক স্কুল রেখে প্রশিক্ষণ চালানো হয়। যেখানে ‘পুরাতন বিমান’ ব্যবহারকে স্বাভাবিক ধরা হয়।

মাত্র ছয় মাস আগে বিয়ে করেছিলেন পাইলট তৌকির ইসলাম সাগর। তার বাবা বলেন, “সাগর ক্যাডেট হতে পারেনি বলে দুঃখ পেয়েছিল। আজও ক্যাডেটই থাকল—মৃত্যুর ক্যাডেট।” ব্ল্যাকবক্সে ধরা পড়ে তার শেষ কথাগুলো—“ইজেক্ট… ইজেক্ট…” কিন্তু ইজেকশন সিট ছিল নীরব।

ব্রিটিশ নির্মিত মার্টিন-বেকার সিটের ব্যাটারি ছয় মাস আগে পরিবর্তনের কথা ছিল—হয়নি। বাজেট কমাতে রক্ষণাবেক্ষণ পিছিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মেইনটেনেন্স লগবুকে তার প্রমাণ মিলেছে। এই অবহেলার মূল্য দিতে হলো ৩১টি প্রাণ (মতান্তরে আরও বেশি) দিয়ে—যার মধ্যে অধিকাংশই শিশু।

দাবি উঠেছে—একটি জনবহুল মহানগরের হৃদয়ে, যেখানে প্রতিনিয়ত লাখো মানুষের পদচারণা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ও আবাসিক এলাকা—সেই রাজধানী ঢাকার মাঝখানে কিভাবে যুদ্ধবিমান চলাচল করতে পারে? কীভাবে প্রশিক্ষণ ফ্লাইট, বিপজ্জনক টেকঅফ ও ল্যান্ডিংয়ের অনুমোদন দেওয়া হয়? দীর্ঘদিন ধরেই তেজগাঁওয়ে অবস্থিত কুর্মিটোলা বিমানঘাঁটি নিয়ে সংশয় ও উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছেন বিশেষজ্ঞ মহল, নগর পরিকল্পনাবিদ ও সাধারণ নাগরিকেরা।

তাঁরা প্রশ্ন তুলছেন—এই বিমানঘাঁটির অস্তিত্ব কি আজ আর প্রাসঙ্গিক? কিভাবে একটি ঘনবসতিপূর্ণ শহরের আকাশে নিয়মিত ফাইটার জেট উড়তে পারে, যার একটিমাত্র প্রযুক্তিগত ত্রুটিই তৈরি করতে পারে ভয়াবহ বিপর্যয়—যেমনটি মাইলস্টোন স্কুল ট্র্যাজেডিতে ঘটল?

অনেকেই বলছেন, এই দুর্ঘটনা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে—বিমান ঘাঁটিটি এখন আর নিরাপদ নয়; এটি একটি সুস্পষ্ট হুমকি। অবিলম্বে কুর্মিটোলা বিমানঘাঁটি রাজধানীর বাইরে অপেক্ষাকৃত খোলা ও ঝুঁকিমুক্ত কোনো এলাকায় স্থানান্তর করা উচিত।

এ নিয়ে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, টেলিভিশন টকশো ও পত্রিকায় সরব হয়েছেন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা।

সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও প্রতিরক্ষা বাহিনীর কাছে এখন জনস্বার্থে এই প্রশ্নের জবাব চাওয়া হচ্ছে—কেন ঝুঁকির মধ্যেই বসবাস করতে হবে রাজধানীবাসীকে? কেন ভবিষ্যতের শিশুদের নিরাপত্তা হবে অনিশ্চিত?

এতো কিছু পরও মানুষ মানুষের জন্য। দুর্ঘটনার পরের মুহূর্তগুলোতে সে দৃশ্য দেখা যায়। বাংলাদেশটাকে আমরা যতই অভিযুক্ত করি, দেশের মানুষ এখনো হৃদয়বান। শত শত বিভিন্ন বয়সের, বিভিন্ন পেশার মানুষ ছুটে আসে হাসপাতালের সামনে। জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউট, সিএমএইচ, উত্তরার বিভিন্ন ক্লিনিক—প্রতিটা জায়গায় মানুষের ভিড়। রক্ত দিতে চায় সবাই, চায় জীবন বাঁচাতে। অনেকে দাঁড়িয়ে থাকে লাইনে, কেউ কেউ নিজের রক্ত দিয়ে বের হয়ে আবার অন্যদের সাহায্য করতে গাড়িতে তুলে দিচ্ছে।

ডাক্তারদের সাথে সাথে পাশে দাঁড়িয়েছে সাধারণ মানুষ। কেউ রোগী বহনের জন্য ফ্রিতে গাড়ি দিচ্ছে। কেউ হাসপাতালের সামনে দাঁড়িয়ে অভিভাবকদের মোটর বাইকে করে ফ্রি রাইড দিচ্ছেন।

তবে বিপরীত চিত্রও আছে। এই মানবতার পাশে মাথা তোলে এক শ্রেণির মুনাফাখোর। এক অভিভাবক নার্গিস সুলতানা বলেন, “জানেন, আমি দোকান থেকে ২০টাকা দামের পানির বোতল কিনতে গেলাম—সে বললো ৬০০ টাকা! বললাম, ভাই আমি তো দুর্ঘটনায় আমার মেয়েকে খুঁজতে এসেছি। সে বলে, ‘নেন নাইলে চলে যান।’”

রক্তদাতাদের একজন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র রিদওয়ান হোসেন বলেন, “জীবনে প্রথম রক্ত দিলাম, ছোট ভাইয়ের মতো একটা বাচ্চার জন্য। কিন্তু বের হয়ে দেখি পাশেই একটা হোটেলে ২০ টাকার বিস্কুট বিক্রি করছে ২০০ টাকায়। এটা কোনো মানুষ করতে পারে?”

এই শহরে ভালোবাসার মানুষ যেমন আছে, তেমনি আছে লোভী, ঠকবাজ আর সংকটে মুনাফা লুটতে চাওয়া নরপিশাচ। কিন্তু দিনের শেষে মানবতাই জিতে যায়—যেখানে সাধারণ রিকশাচালক শিশু উদ্ধার করে নায়ক হন, আর স্বার্থপর ব্যবসায়ী হয়ে যান এক তিক্ত স্মৃতি।

২১ জুলাই ২০২৫, ঢাকার একটি স্কুলে আকাশ থেকে নেমে এসেছিল আগুন। শুধু ভবন পুড়েনি, পুড়েছে কত শত স্বপ্ন, কত শত অসমাপ্ত বাক্য। বাংলাদেশ এমন একটি রাষ্ট্র, যেখানে দুর্ঘটনা মেনে নেওয়া হয় ভাগ্য বলে, অব্যবস্থাপনা ভুলে যাওয়া হয় আমলাতান্ত্রিক স্বস্তির তলায়। যেখানে এক মায়ের মৃত্যু হয় শুধু এই কারণে যে তিনি মেয়েকে খুঁজতে গিয়েছিলেন।

আকাশ থেকে ছুটে এসে ধাক্কা খায় যুদ্ধবিমানটি উত্তরার মাইলষ্টোন স্কুল ভবনের ছাদে

মাহরিন চৌধুরী আমাদের দেখিয়ে দিয়েছেন, শিক্ষকতা শুধু পেশা নয়—এ এক আত্মত্যাগের ধর্ম, নিঃশর্ত ভালোবাসার ছায়া। কিন্তু সেই মাহরিনের দাফনে ছিল না রাষ্ট্রীয় কোনো সম্মান, ছিল না কোনো মন্ত্রী বা পতাকা। কারণ তিনি ছিলেন ‘ক্লাসরুমের সৈনিক’ একজন সাধারণ শিক্ষিকা মাত্র।

ধ্বংসপ্রাপ্ত চীনা তৈরি F-7 BGI প্রশিক্ষণ বিমান



আরো খবর: